গত সোমবার ত্রিপুরার মাটিতে পা দিয়েই বিজেপি সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২৩ সালে বিধানসভা নির্বাচন উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে। আর অভিষেক দাবি করছেন, দেড় বছরের মধ্যে ত্রিপুরায় সরকার গড়বে তৃণমূল কংগ্রেস। ডায়মন্ড হারবারের তরুণ সাংসদের দাবি, তৃণমূল যখন ত্রিপুরায় পা দিয়েছে, সরকার গড়েই ত্রিপুরা ছাড়বে। ত্রিপুরার মানুষকে মুক্তি দিতেই তাঁর এখানে আসা। কিন্তু অভিষেকের ত্রিপুরা জয় কী এত সহজ হবে? কারণ গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে লড়াই করা ছাড়াও আরও একটি ফ্যাক্টর রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সামনে। আর তিনি হলেন মহারাজা প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য। ত্রিপুরা রাজ পরিবারের এই সদস্যকে ঘিরেই মাথা চাড়া দিচ্ছে গ্রেটার তিপ্র্যাল্যান্ড ইস্যু।
প্রশান্ত কিশোরের রিপোর্টে প্রদ্যোতকে নিয়ে শঙ্কা
ত্রিপুরায় তৃণমূলের সম্ভাবনা কেমন? তাই নিয়ে সম্প্রতি প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাক (IPAC) একটি প্রাথমিক রিপোর্টে তৈরি করেছে। সূত্রের খবর, তাতে জোট না গড়লে তৃণমূলের খুব একটা আশা দেখতে পাওয়া যায়নি। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া থাকলেও, বিজেপিকে সরানোর মতো কোনও রাজনৈতিক শক্তি এখনও নেই। বিজেপিকে সরাতে প্রয়োজন বিকল্প রাজনৈতিক দল এবং নেতা। সমীক্ষকদের তরফে আরও দাবি করা হয়েছে, উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে তৃণমূলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। তৃণমূলকে রাজ্যে মাথা তুলতে গেলে নতুন মুখের প্রয়োজন। আর এই সমীক্ষা রিপোর্টেই উঠে এসেছে, ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলে তিপ্রা মথার সুপ্রিমো প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। যিনি একাই বিজেপিকে সরাতে অনেকটাই ভূমিকা নিতে পারেন। অন্যদিকে বিজেপিতে বিক্ষুব্ধ বলে পরিচিত সুদীপ রায় বর্মন ভাল নেতা হলেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমেছে। কারণ মানুষের আস্থা কমেছে তাঁর ওপর থেকে। একাধিকবার দল বদল করেছেন তিনি। কংগ্রেস থেকে তৃণমূল। আবার সেখান থেকে বিজেপি। মধ্যে তৃণমূলে ফিরবেন বলে জল্পনা তৈরি হয়েছে। মানুষ বারে বারে দলবদল মেনে নিতে পারছেন না।
কে এই প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য?
ত্রিপুরার রাজপরিবারের সর্বশেষ বংশধর প্রদ্যোত। তাঁর বাবা কীর্তি বিক্রম কিশোর মাণিক্য, ত্রিপুরা রাজবংশের ১৮৫তম এবং শেষ রাজা। সেই হিসেবে প্রদ্যোত বংশের ১৮৬তম প্রধান। প্রদ্যোতের দাদা কিশোর দেববর্মার আমলেই এই রাজ্য ভারতভুক্ত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পুরোনো রাজবংশ এটা। শত শত বছরের জীবন্ত ইতিহাস রয়েছে এ বংশের। এক কালে খাসিয়া পাহাড় থেকে উত্তর আরাকান পর্যন্ত ছিল তাদের প্রভাব। তিপ্রাদের সেই স্মৃতির প্রতীক প্রদ্যোত। সেই সূত্রেই তিনি এই জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ ‘মহারাজা’। তবে এই মহারাজা গতানুগতিক নন, আমলাতান্ত্রিকও নন। ত্রিপুরার প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত ট্রাইবালদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র আছে। বোঝা যায়, পরিবারের সামন্ততান্ত্রিক খোলস ছেড়ে রাজনীতি করা তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। কেবল স্মৃতির মাঝে থাকতে চান না এই যুবক। নিজেকে ‘রাজনীতিবিদ’ও বলতে নারাজ। ‘অ্যাকটিভিস্ট’ বললে খুশি হন।
ত্রিপুরার রাজনীতিতে বিপ্লব দেবের বিকল্প হিসাবে ক্রমে উঠে আসছে মহারাজা প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্যর নাম। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে স্বশাসিত জেলা পরিষদের ভোটে বিজেপি ও তার জোট অংশীদার IPFT ব্যাপক ভাবে পরাস্ত হয়েছে প্রদ্যোত মাণিক্যের দলের কাছে। প্রদ্যোতের রাজনৈতিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের হাত ধরে। প্রদ্যোতকে ২০১৯-এ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি করেছিলেন স্বয়ং রাহুল গান্ধী। এর আগে ছাত্ররাজনীতি করেছেন তিনি। সাংবাদিকতাও করেছেন। দ্য নর্থইস্ট টুডে নামে তাঁর একটা সংবাদমাধ্যম ছিল। প্রদ্যোতের বাবার আমল থেকে এই পরিবার কংগ্রেসভুক্ত। রাজা কীর্তি কংগ্রেস থেকে লোকসভার সদস্য ছিলেন চারবার। প্রদ্যোতের বোন ‘রাজকুমারী’ প্রজ্ঞা গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে লড়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার বছরই প্রদ্যোত দল ছাড়েন। তাঁর অভিযোগ, জাতীয় দলগুলো অঞ্চলকে তাদের মতো করে দেখতে চায়। প্রদ্যোত চাইছেন ত্রিপুরার মতো প্রান্তিক অঞ্চলের ক্ষমতায়ন। বিশেষ করে ট্রাইবালদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। তারই জের, কংগ্রেস ছাড়ার পরই তিনি পাহাড়ি-ত্রিপুরায় কম্পন তুলেছেন।
‘তিপ্রা মথা’র জন্ম
উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর ভোটে কংগ্রেসের নিরাপদ এলাকা ছিল বহুকাল। সেটা ভাঙতেই এনআরসি-কার্ড নিয়ে আসে বিজেপি। এসব এলাকার ট্রাইবালরা তাতে একাত্মতা প্রকাশ করে। কিন্তু বিজেপি যখন এনআরসির পাশাপাশি নতুন নাগরিকত্ব আইনে হিন্দুদের এই অঞ্চলে নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছে, তখন এনআরসির বিরোধিতায় নামে স্থানীরাই। সেই সময় কংগ্রেস জাতীয়ভাবে এনআরসির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এতে প্রদ্যোত দেববর্মার সায় ছিল না। তিনি চাইলেন উত্তর-পূর্ব ভারতে এনআরসি হোক। এভাবেই তাঁর কংগ্রেসজীবনের ইতি ঘটে। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্ডিজিনিয়াস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স (‘টিআইপিআরএ’ বা তিপ্রা) নামে একটা দল গড়েন প্রদ্যোত। সংক্ষেপে ডাকা হচ্ছে ‘তিপ্রা মথা’ বলে। মথা অর্থ ‘ঐক্য’। তিপ্রা-মথা ত্রিপুরার ট্রাইবাল সমাজে ইতিমধ্যে ইতিবাচক সারা ফেলেছে। নবীন দল হিসেবে তিপ্রা ত্রিপুরার ভেতর-বাইরে সব জায়গার ত্রিপুরিদের নিয়ে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড করতে চায়। যার ভরকেন্দ্র হবে ত্রিপুরার এখনকার স্বশাসিত ‘এডিসি এলাকা’। প্রদ্যোতের এই আওয়াজের পরই ত্রিপুরার ভেতর-বাইরে ত্রিপুরিদের এখন রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয় তিপ্রা-মথা। প্রদ্যোত কংগ্রেস ছাড়ায় বিজেপি উল্লসিত ছিল। কিন্তু প্রদ্যোত-ঝড়ে প্রথমেই সর্বনাশ হয় তাদের। রাজ্যে ট্রাইবালদের স্বশাসিত যে কাউন্সিল রয়েছে, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় ‘এডিসি এলাকা’, তার নির্বাচনে প্রদ্যোতের দল তিপ্রা-মথা ২৮টি আসনের ১৮টিতেই জেতে। ‘ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলে’র ওই নির্বাচনে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল তিপ্রা-মথা। রাজ্যে বিজেপিই ক্ষমতায়। কিন্তু তিপ্রা-মথার সামনে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি তারা। মাত্র ৯টি আসন পেয়েছে। সব আসন মিলে তারা প্রদত্ত ভোটের ১৯ ভাগ পেয়েছে। তিপ্রা-মথা একাই ৩৭ ভাগ ভোট পায়।
আদিবাসীরা ত্রিপুরা ভোটে কতটা ফ্যাক্টর
২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের অন্যতম কান্ডারী ছিল তপশিলি জাতি ও জনজাতির ভোট ব্যাঙ্ক। অধিকাংস আসনেই বিজেপি-আইপিএফটি জয়ের ধ্বজা উড়াতে পেরেছিল। ২০১৮ সালের ভোটে বিজেপি ও সহযোগী IPFT ক্ষমতায় আসে তিপ্র্যাল্যান্ড ইস্যু নিয়ে। কিন্তু সরকারে থাকার ৩ বছর হয়ে গেলেও চুপ বিজেপি-IPFT সরকার। প্রত্যেক নির্বাচনেই দলিত ও জনজাতি তাস রাজনৈতিক দলগুলির জয়ের রসদ যুগিয়ে থাকে। তাই তপশিলি জাতি ও জনজাতিদের ভোট নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রায় দেড় বছর বাকি থাকতেই সলতে পাকাতে শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিদের ত্রিপুরায় ঘনঘন সফর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মাঝেই প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য গ্রেটার তিপ্র্যাল্যান্ডের দাবি উসকে দিয়েছেন। হিসাব বলছে ত্রিপুরায় ৩১% জনজাতি ভোট। ৬৯% ভোট বাঙালি ভোট। এই জনজাতি ভোট ত্রিপুরার ২০টি বিধানসভা আসনে সংরক্ষিত। যার ওপর সরকার গঠন নির্ভর করে৷ একটা সময় জনজাতিদের ভোট ছিল বামেদের দিকে। পরবর্তী সময়ে বামেদের সেই ভোট চলে যায় IPFT এর দিকে। কিন্তু সরকারে আসার পরে তিপ্র্যাল্যান্ডের দাবি নিয়ে চুপ বিজেপি৷ তাই দোটানায় IPFT। স্বশাসিত জেলা পরিষদের ভোটের আগে এই নিয়ে সরব হয়েছিল তারা। কিন্তু অজানা কারণে ফের চুপ। আর এই জনজাতি ভোটকে হাতিয়ার করেই এগোচ্ছে প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য। প্রদ্যোতের লক্ষ্য এখন ট্রাইবাল কাউন্সিলের বাইরের তিপ্রাদের দিকে। তাঁর কথা ‘আমি প্রত্যেক তিপ্রাকে সঙ্গে চাই’।
বাংলাভাষী আর তিপ্রাদের মধ্যে বিভেদ রেখা
প্রদ্যোত বার্তা দিচ্ছেন, মাণিক্য বংশের আমলে ত্রিপুরার সব জনজাতি বেশি সুরক্ষিত ছিল। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকেরা সেই সুদিন নষ্ট করেছে। এখন তিনি ত্রিপুরার রাজনীতিকে দিল্লি ও আগরতলার আধিপত্য মুক্ত করতে চান। প্রদ্যোতের কথায় আকৃষ্ট হচ্ছে তিপ্রা তারুণ্য। এই তরুণের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য নেই। সন্ত্রাসী কোনো ভাবমূর্তিও নেই। উপরন্তু তিনি ট্রাইবালদের স্বশাসনের কথা বলছেন গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায়। ফলে প্রদ্যোতকে মোকাবিলায় বিজেপি থেকে বামফ্রন্ট- কারও হাতে বিশেষ কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু বাংলাভাষী সমাজে তাঁর ভোট নেই। বাংলাভাষীদের বাদ দিয়েই ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন তিনি। ‘নিজের মানুষ’ বলতে তাঁর আছে কেবল তিপ্রারা। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের আওয়াজ আরও তীব্র করে ইতিমধ্যে রাজ্যের দুটি রাজনৈতিক দল আইপিএফটি (তিপ্রাহা) এবং তিপ্রাল্য়ান্ড স্টেট পার্টি-র সাথে জোট বেঁধেছেন প্রদ্যোত। এদিকে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড কার্যকরী হলে রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ তথা বিচ্ছিন্নতাবাদ যেমন মাথা চাড়া দেবে, পরিণামে জাতি-জনজাতির একতা-সম্প্রীতি, উন্নয়ন সবকিছুই ধ্বংস হবে। তাই সামগ্রিক বিচারেই গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড বিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে আমরা বাঙালি দল।
২০২৩-এ কোন সমীকরণ উঠে আসবে?
৬০ সদস্যের ত্রিপুরা বিধানসভায় প্রায় অর্ধেক আসনে ট্রাইবালদের প্রভাবে আছে। তার মধ্যে ২০টি তাদের জন্যই সংরক্ষিত। পাহাড়ি দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে পারলে প্রদ্যোতের পক্ষে রাজনীতিতে বাংলাভাষী নেতাদের কোণঠাসা করা কঠিন হবে না। নতুন দল গড়ার সময় প্রদ্যোতের সঙ্গে হেভিওয়েট কোনো রাজনীতিবিদ ছিল না। এখন ট্রাইবাল সমাজে তাঁর প্রভাব বাড়ছে। পুরোনো তিপ্রা রাজনীতিবিদেরা ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে নতুন দলে। ত্রিপুরায় সবার চোখ ২০২৩-এর দিকে। এই বছর বিধানসভা নির্বাচন হবে। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং বিজেপির ত্রিমুখী গণিতের অনেক হিসাব এখন আর মিলছে না প্রদ্যোতের আবির্ভাবে। তার সঙ্গে আবার ত্রিপুরা রাজনীতিতে নতুন সংযোজন তৃণমূল কংগ্রেস। প্রদ্যোতকে ঘিরে ভবিষ্যতে ট্রাইবাল দলগুলোর একটা জোট হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে ত্রিপুরায় জমি শক্ত করতে আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক ধরতে চাইছে তৃণমূলও। আদিবাসী আবেগ ধরতে ত্রিপুরার মানুষকে 'কের পুজো'র শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রিপুরায় ইতিমধ্যেই তৃণমূল সাংগঠনিকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। উত্তর ত্রিপুরা, উনকোটি, ধলাই-সহ বিভিন্ন জায়গায় সংগঠন বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। তবে প্রদ্যোত কিশোরের উপস্থিতিতে তা কতটা সফল হবে সেই প্রশ্নচিহ্ন থাকছেই।