অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ইতিমধ্যেই ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে দেশজুড়ে সাত দফায় ভোট প্রক্রিয়া চলবে। তারপর ৪ জুন নির্বাচনের ফল ঘোষণা। প্রায় সমস্ত সমীক্ষাতেই এবারের নির্বাচনেও এগিয়ে রয়েছে গেরুয়া শিবির। বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় বঙ্গেও 'মোদী ঝড়' ওঠার ইঙ্গিত মিলেছে। অন্যদিকে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসও পিছিয়ে নেই তাদের ক্যাম্পেইনে। দুই শিবিরই গত লোকসভা ভোটের থেকে এপর্যন্ত নিজেদের কাজের খতিয়ান তুলে ধরার পাশাপাশি, বঞ্চনার কথাও প্রচারের আলোয় আনছে।
একদিকে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেসের 'দুর্নীতি'র প্রসঙ্গকে হাতিয়ার করে ময়দানে নেমেছে, অন্যদিকে জোড়া ফুল শিবিরও রাজ্যবাসীর উপর 'কেন্দ্রীয় বঞ্চনা'র কথা তুলে ধরছে ভোট প্রচারে। এমত পরিস্থিতিতে, পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে যে আসনগুলি নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে, তার মধ্যে অন্যতম কেন্দ্র মালদা উত্তর।
এমনিতে গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের আসনগুলিতে বিজেপি বেশ ভাল ফল করেছে। ২০১৯-র নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের জেতা আসনগুলির মধ্যে ৭টি আসন ছিল উত্তরবঙ্গে। ফলে এবারও বিজেপির কাছে এই আসনগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের জয়ী প্রার্থী
* কোচবিহার- নিশীথ প্রামানিক (বিজেপি)
* আলিপুরদুয়ার - জন বার্লা (বিজেপি)
* জলপাইগুড়ি - জয়ন্ত রায় (বিজেপি)
* দার্জিলিং- রাজু বিস্তা (বিজেপি)
* রায়গঞ্জ - দেবশ্রী চৌধুরী (বিজেপি)
* বালুরঘাট- সুকান্ত মজুমদার (বিজেপি)
* মালদা উত্তর- খগেন মুর্মু (বিজেপি)
* মালদা দক্ষিণ - আবু আসেন খান চৌধুরী (কংগ্রেস)
এবার আসা যাক, এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম মালদা উত্তরে। ডিলিমিটেশনের ফলে ২০০৯ সালে মালদা লোকসভা কেন্দ্রটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হয় মালদা উত্তর, অপরটি হয় মালদা দক্ষিণ। আনুমানিক ১৪,২৫,৪২৮ জন বৈধ ভোটার নিয়ে মালদা উত্তরে ভোটগ্রহণ হতে চলেছে আগামী ৭ মে। মূলত হবিবপুর, গাজল, চাঁচোল, হরিশচন্দ্রপুর, মালতিপুর, রতুয়া এবং মালদা বিধানসভা কেন্দ্রগুলি রয়েছে এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে। গত শতাব্দীর ৭০ ও ৮০-র দশকে এই এলাকায় গোনি (গনিখান চৌধুরী) ম্যাজিক চললেও, বাম জমানায় তা ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে। তবে কংগ্রেসের দাপট এই লোকসভা কেন্দ্রে ২০১৯ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে ২০১৯-এ সদেশ জুড়ে মোদী ঝড়ের প্রভাব এসে পড়ে ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই কেন্দ্রে।
মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা বিধানসভা কেন্দ্রগুলির ২০২১ নির্বাচনের ফল
* হবিবপুর- জয়েল মুর্মু (বিজেপি)
* গাজল- চিন্ময় দেব বর্মন (বিজেপি)
* চাঁচল- নিহার রঞ্জন ঘোষ (তৃণমূল কংগ্রেস)
* হরিশচন্দ্রপুর- তাজমুল হুসেন (তৃণমূল কংগ্রেস)
* মালতিপুর- আব্দুর রহমান বক্সি- (তৃণমূল কংগ্রেস)
* রতুয়া- সমর মুখার্জী (তৃণমূল কংগ্রেস)
* মালদা- গোপাল চন্দ্র সাহা- (বিজেপি)
মূলত, আম চাষ ও কৃষিজীবী নির্ভর মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে রয়েছে একাধিক সমস্যা। তৃণমূল- কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে এখানে অভ্যন্তরীন লড়াই যথেষ্টই বড় আকার ধারণ করেছে। একদিকে টিকিট না পেয়ে, কিছুটা হলেও বিক্ষুদ্ধ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মৌসম বেনজির নূর। এই আসনে এবার জোড়া ফুলের প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ী প্রার্থী খগেন মুর্মুকে এবারও টিকিট দিয়েছে গেরুয়া শিবির। আর তা নিয়েই, কিছুটা অভ্যন্তীন দ্বন্দ্বে ভুগতে হচ্ছে বিজেপি নেতৃত্বকে। তবে এসব থেকে বেশ কিছুটা দূরে সমঝোতার পথে হেঁটে, বামেদের সমর্থন নিয়ে সেখানে প্রার্থী দিয়েছে কংগ্রেস। তাদের এবারের প্রার্থী মোস্তাক আলম।
এই কেন্দ্রের ভোটারা মূলত, কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে এসেছিল প্রথম থেকে। ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে কংগ্রেসের টিকিটের মৌসম জয়ী হলেও, পরবর্তীতে ২০১৯ -এ তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। মূলত, মালদা উত্তরকে নিজেদের পকেটে ভরার তাগিদে সেবারই তাঁকে টিকিট দেয় জোড়া ফুল শিবির। কিন্তু তাঁর ফল খুব একটা ভাল হয়নি। মালদার দাপুটে নেতা, কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী গোষ্ঠী বিষয়টি ভাল ভাবে নেয়নি। এর ফলে, সেখানে ভোটের ডিভিডেন্ট নিয়ে যায় বিজেপি। জয়ী হন, তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ এবং সেই সময়ের সদ্য গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়া খগেন মুর্মু। এবার এই আসনে ইকোয়েশনটা বেশ জটিল 'দুই ফুলে'র কাছেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দুই দলেই বেশ কিছু বিক্ষুব্ধ রয়েছেন। ফলে সেখানে আন্ডার কারেন্ট কাজ করতে পারে। অন্যদিকে এই টানাপোড়েনের মাঝে কংগ্রেস নিজেদের হারানো জমি ফিরে পাওয়ার একটা মরিয়া চেষ্টা করবে।
এবারের ভোটে প্রধান ইস্যু
কৃষিজীবী নির্ভর এই জেলায় গত কয়েক বছরে গরু পাচার থেকে সীমান্ত পার, সন্ত্রাস, অনুপ্রবেশের মতো একাধিক অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল- কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি সহ অন্যান্য দলগুলি সেই ইস্যুকেই হাতিয়ার করে প্রচারে নামছে। তার উপর রয়েছে জোড়াফুল শিবিরের গোষ্ঠী কোন্দলের ছবি। জেলার বেশ কয়েকটি এলাকা সীমান্তবর্তী এবং সেখানে মূলত সংখ্যালঘুদের বাস। রাজ্যের শাসক দলের অভিযোগ, ভোট চাওয়ার নামে ওই এলাকাগুলিতে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করছে, বিজেপি।
অবিভক্ত মালদা লোকসভা কেন্দ্রে কারা জয়ী
* ১৯৫২- সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ (কংগ্রেস)
* ১৯৫৭- রেণুকা রায় (কংগ্রেস)
* ১৯৬২- রেণুকা রায় (কংগ্রেস)
* ১৯৬৭- উমা রায় (কংগ্রেস)
* ১৯৭১- দীনেশ চন্দ্র জোয়ারদার- (সিপিআইএম)
* ১৯৭৭- দীনেশ চন্দ্র জোয়ারদার (সিপিআইএম)
* ১৯৮০-২০০৪- এবিএ গোনি খান চৌধুরী (কংগ্রেস)
* ২০০৬- আবু হাসেম খান চৌধুরী (কংগ্রেস)
* ২০০৯- মৌসম বেনজির নূর (কংগ্রেস)
২০১৪ সালে ডিলিমিটেশনের পরে উত্তর মালদায় জয়ী
* ২০১৪- মৌসম বেনজির নূর (কংগ্রেস)
* ২০১৯- খগেন মুর্মু (বিজেপি)
* ২০২৪-???
রাজনৈতিক দড়ি টানাটানাইর মাঝে কিন্তু গ্রামীণ মালদা অন্য কথা বলছে। স্থানীয়দের অধিকাংশেরই অভিযোগ, "বছর- বছর ভোট আসে এবং ভোট যায়, আমরা যে তিমিরে পড়েছিলাম, সেখানেই রয়ে গিয়েছি"। ২০১৯ সালে উত্তর মালদার কেন্দ্রটি বিজেপি জিতলেও, সেখানে চাঁচোল, হরিশচন্দ্রপুর, মালতিপুর, রতুয়া, মানিকচক বিধানসভা কেন্দ্রগুলি ২০২১-র বিধানসভা কেন্দ্রগুলি দখল করে তৃণমূল- কংগ্রেস। ২০২৪-র নির্বাচনে একদিকে 'মোদীর গ্যারান্টি', অন্যদিকে 'দিদির প্রকল্প'র ভিত্তিতে ভোট হবে। আবার কংগ্রেস, পুরনো 'গনি মিথ'কে কাজে লাগিয়ে জমি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করবে। এখন দেখার বিষয় কারা এই কেন্দ্রে শেষ হাসি হাসে।