
বুদ্ধদেব গুহ ঋজুদা সিরিজে 'বনবিবির বনে' লিখেছিলেন, 'বাউলে, মউলে ও জেলেদের নৌকাগুলো মাঝে মাঝে গহীন দুপুরে এসে লাগে এই ছোট বালিতে। তারপর মুখে উলু দেওয়ার মতো অদ্ভুত আওয়াজ করে জলের কলসি নিয়ে মিষ্টি জলের কুণ্ড থেকে জল তুলে নিয়ে যায় ওরা বড় ভয়ে-ভয়ে। বাঘ যে কোথায় কখন এসে হাজির হবে, তা কেউই জানে না। বনবিবির পুজো দেয় ওরা, বাবা দক্ষিণরায়ের। পায়রা কি পাঁঠা বলি দেয় ঠাকুরের নামে। কোঁচড় ভরে আছাড়ি পটকা নিয়ে ডাঙায় নামে।'
'হয় বিশ্বাস, নয় জ্ঞান'
দ্বিতীয় দফায় ভোট সুন্দরবনের ৪ বিধানসভায় ভোট। গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ ও সাগর। দক্ষিণ ২৪ পরগনা তৃণমূল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। ২০১৯-এর লোকসভায় বিধানসভাওয়াড়ি ফলে এখানে প্রতিটি আসনেই লিড ছিল তৃণমূলের। আয়লা, আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবনের উন্নয়ন কতটা হয়েছে বা হচ্ছে, তা নিয়ে নানা আলোচনা বা তর্কের অবকাশ থাকলেও, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বাসিন্দারা একটি বিশ্বাসের উপরেই ভর করে দিন গুজরান করেন। সাইক্লোন, বন্যা, ভাঙন-- প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শেষ নেই। প্রতিবারই ভোট দেন ওঁরা। তবু প্রকৃতির ক্ষোভের সঙ্গে যুঝতে হয় নিজেদেরই। বড় ভরসার জায়গা ওই বাঘের পিঠে চড়ে থাকা মেয়েটি। সরকার, রাজনৈতিক দলগুলির উর্ধ্বে 'বনবিবি'।
কে এই বনবিবি?
কোনও ঝড়কে কি ঈশ্বর পরাস্ত করতে পারেন? ঈশ্বর বিশ্বাসীরা বলবেন, 'সবই তো তাঁর খেলা।' আসলে জঙ্গলের প্রবল প্রতিকূল জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ে ওই বিশ্বাসটাই মনের জোর বাড়ায়। আয়লাতেও হয়েছিল, আমফানেও। তেমনই এক বিশ্বাসের নাম বনবিবি। সুন্দরবনের দেবী। বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি একই সঙ্গে হিন্দুধর্মের দেবী ও ইসলাম ধর্মের পিরানি রূপে পূজিত হন। বনবিবির উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা মতান্তর আছে। হিন্দুশাস্ত্র মতে বনবিবি হলেন, কালী, চণ্ডী, শীতলা, বনদুর্গা, বিশালাক্ষী ইত্যাদি নানা দেবীর রূপ।
আবার কিংবদন্তি, মক্কা থেকে আসা ইব্রাহিম ফকিরের মেয়ে বনবিবি। ইব্রাহিমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবি যখন তাঁকে কোনও সন্তান দিতে পারেন না, তখন ফুলবিবির অনুরোধে গুলালবিবিকে বিয়ে করে ইব্রাহিম। ফুলবিবির শর্ত ছিল, গুলাল বিবি অন্তঃসত্ত্বা হলে, তাঁকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। এবং জঙ্গলের মধ্যেই তাঁর সন্তান জন্মাবে। শর্ত অনুসারে গুলালবিবি যখন সন্তানসম্ভাবা হলেন, তখন ইব্রাহিম তাঁকে জঙ্গলে ছেড়ে দিলেন।
জঙ্গলের মধ্যে গুলালবিবি যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে প্রসব বেদনা সহ্য না করতে পেরে মারা গেলেন। সদ্যোজাত শিশু দুটির কান্না শুনে বনের সমস্ত পশুপাখি ও গাছপালা ছুটে আসে তাদের কাছে। তারাই দুই ভাই-বোনকে লালন-পালন করে বড় করে তোলে। শিশু দু’টি একটু বড় হলে শুধু ছেলেকেই ঘরে নিয়ে যান ইব্রাহিম। একা মেয়ে বড় হয় এক হরিণ মায়ের কাছে। আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভালো-খারাপ তাঁর নখদর্পণে চলে আসে। বাঘের হাত থেকে সেই মেয়ে অনেক মানুষকে বাঁচাতে থাকে।
ইতিমধ্যে ছেলে শাহ জাঙ্গুলিকে নিয়ে মক্কায় ফিরে যান ইব্রাহিম। পরবর্তী কালে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইব্রাহিম মক্কায় বনবিবিকেও নিয়ে আসেন। এ দিকে সুন্দরবনের সব প্রাণীরা দক্ষিণরায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাঁদের অনুরোধে এবং এক দৈববাণীর আহ্বানে বনবিবি আর তারঁ ভাই শাহ জাঙ্গুলি সুন্দরবনে আবার ফিরে আসেন।
সুন্দরবনের বাঘ দক্ষিণরায়ের সবচেয়ে বড় শত্রু হলেন বনবিবি। তাই বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বনবিবি-ই ভরসা সুন্দরবনের একটি বড় অংশের মানুষের। মোদ্দা বিষয়, বনবিবি হলেন জঙ্গলে রক্ষাকর্ত্রী।
বনবিবি ও রাজনীতি
বনবিবির গল্পেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, সুন্দরবনের এই দেবীর সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে একাকার। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় সুন্দরবনে একটি বিতর্কি তৈরি হয়েছিল। যে বিতর্ক এখনও আছে। তা হল, বনবিবির নাম পরিবর্তন করে বনদেবী করার চেষ্টা। সুন্দরবনে পঞ্চায়েত স্তরে একাধিক বিজেপি নেতার বক্তব্য ছিল, মুসলিমরা আর বনবিবির পুজো করেন না। মূলত, হিন্দুরাই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই বনবিবির চেয়ে বনদেবী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এখন এই দাবি কতটা সত্যি, কতটা প্রোপাগান্ডা, তা নিয়ে যথেষ্ট তর্কের অবকাশ থাকছেই।
যদিও লোকসভায় বনবিবির নাম পরিবর্তন ইস্যু উঠলেও, ভোটের ফলে তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি। গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর সহ সুন্দরবনের বিধানসভাগুলিতে লিড ছিল ঘাসফুলের।
আমফান ও একুশের নির্বাচন
আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবনে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। সেই দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করেই সুন্দরবনে প্রভাব বাড়াতে মরিয়া বিজেপি। যদিও আমফানের ত্রাণ দুর্নীতিতে বহু অভিযোগ রয়েছে বিজেপি শাসিত পঞ্চায়েতগুলির নেতাদের বিরুদ্ধেও।
গত ২৪ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গোসাবার জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে বলেন, 'আমফানের পর কেন্দ্র থেকে বাংলাকে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা ক্ষতিগ্রস্তরা পাননি। ভাইপো অ্যান্ড কোম্পানি সেই টাকা নিয়ে নিয়েছে।'
পাল্টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিনই পুরুলিয়ায় জনসভায় বলেন, 'শুনলাম আজ গোসাবায় গিয়ে বলেছে, ওরা নাকি আমপানের টাকা দিয়েছে। কাঁচাকলা দিয়েছে। এক পয়সা দেয়নি। মিথ্যেবাদীর দল। ডাকাতের দল। কুৎসার দল। অপপ্রচারের দল।'
তাই একুশের ভোটে সুন্দরবনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বিজেপি আমফান ত্রাণ দুর্নীতির অভিযোগের আক্রমণে ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখা।
এহেন শাহ-মমতার এহেন তর্জায় সুন্দরবনবাসী কী ভাবছেন? বনবিবি-ই জানেন!