We don't support landscape mode yet. Please go back to portrait mode for the best experience
১৯৭১ সালের ১৩ জুন। সৈয়দপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল একটি বিশেষ ট্রেন। সৈয়দপুর থেকে চিলাহাটি সীমান্ত হয়ে ভারতের জলপাইগুড়ি যাবে। মধ্যরাতে নিঃশব্দে ট্রেনে উঠতে থাকে সৈয়দপুরের প্রায় ৪৫০ মাড়োয়ারি ও বাঙালি হিন্দু নারী,পুরুষ ও শিশু। সবাই পরস্পরের পরিচিত। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। সবাই উদ্বিগ্ন, প্রাণভয়ে আতঙ্কিত। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় সময়ও যেন কাটছে না। একটি ক্ষণ কত যুগের সমান। সুনসান নীরবতা দেখে বোঝার উপায় নেই, একটু পরেই ট্রেনটি সাক্ষী হতে চলেছে এক নির্মম হত্যালীলার।
নিরঞ্জন কুমার আগরওয়াল নিজু। বাংলাদেশের উত্তরের জেলা নীলফামারির সৈয়দপুরের গোলাহাটে ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া নির্মম এক হত্যালীলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর ব্যবসায়ী বাবা রামেশ্বর লাল আগরওয়াল, বাবার তিন ভাই, খুড়তো-জেঠতুতো ভাই ও তাদের বউ-সন্তান সহ সেদিন নিজুর পরিবারের নয় জন সদস্য গোলাহাটের গণহত্যায় শহিদ হন। সৈয়দপুরের আরও অনেক পরিবারের সকল সদস্যকেই সেদিন হত্যা করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগের পর রেলওয়ে কারখানায় কাজের সুবাদে বিপুল সংখ্যক অবাঙালি মুসলিম (উর্দুভাষী) ভারত থেকে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে বাংলাদেশের উত্তরের শিল্প-বাণিজ্যের প্রধান শহর সৈয়দপুরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিকামী বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিহারি মুসলিমরা। এরা ছিল হানাদার পাকবাহিনীর বিশ্বস্ত দোসর। তাদের সঙ্গে এখানকার বাঙালিদের মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব ছিল দেশভাগের পর থেকে। এদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয় সৈয়দপুর।
নিজু জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই অবাঙালি অধুষ্যিত সৈয়দপুর শহরের বাঙালি ও উর্দুভাষীদের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। তখনকার মুসলিম লিগ নেতা এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইজাহার আহমেদ , তাঁর ছোট ভাই নেছার আহমেদ, তৎকালীন এনএসএফ নেতা তৌকির আহমেদ কেনেডি এবং আরও যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে পাক বাহিনী ১ জুন ১৯৭১ সালে ১৮৫ জন মাড়োয়ারি-হিন্দু পুরুষকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর গুলের নির্দেশে তাঁদেরকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সংস্কার এবং মাটিকাটার কাজে লাগিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ১২ জুন এক প্রতারণামূলক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রেনযোগে সীমান্তবর্তী হলদিবাড়ি স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে নরঘাতক মেজর গুল তাদেরকে জানায়।
নিজু আরও জানান, পরিকল্পনা মোতাবেক আটক ১৮৫ জন মাড়োয়ারি এবং হিন্দু পুরুষকে ৪-৫ টি ট্রাকে ১৩ জুন ভোরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈয়দপুর রেল স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজে বাড়ি গিয়ে পরিবার-পরিজনসহ দ্রুত রেল স্টেশনে ফিরতে বলা হয়। তাঁরা কিছুটা আনন্দ চিত্তে বাড়ি যান। অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়ি থেকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-শিশু সন্তানসহ সকলকে নিয়ে তাঁরা মোট ৪৪৭ জন রেল স্টেশনে আসেন।
তারপরের ঘটনা বলতে গিয়ে নিজুর চোখ ছলছল করে উঠল। এত বছর পরেও কান্না চাপতে পারলেন না। নিজু জানালেন, হানাদার বাহিনী এবং অবাঙ্গালি বিহারিরা তাঁর সামনেই পুরুষদেরকে দু’টি এবং নারী-শিশুসহ মহিলাদেরকে ভিন্ন দু’টি বগিতে তুলে সকল জানালা-দরজা বন্ধ করে দেয়। ট্রেনটি সকাল ৭টার দিকে ছেড়ে যায়।
নিজুর কথায়, 'ধীর গতিতে ট্রেনটি রওনা দিয়ে স্টেশন থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে গোলাহাট নামক স্থানে রেললাইনের কালভার্টের ওপর থেমে যায়। আমি ট্রেনটির পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়াই। এ সময় আশেপাশের ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর স্থানীয় গ্রামবাসীরা লুকিয়ে পড়ে।'
নিজু দেখতে পান, বগির দরজা খুলে একজন করে আট নারী-পুরুষ-শিশুকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে হানাদার এবং তাদের দোসর বিহারিরা ধারালো অস্ত্র, রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংস ও বীভৎস গণহত্যা চালাচ্ছে। শিশুরা চিৎকার করায় তাদেরকে রেল লাইনের ওপর আছাড় দিয়ে এবং উপরে ছুড়ে ফেলে নীচে বেয়নটে ধরে যুদ্ধাপরাধীরা তাদেরকে হত্যা করে। ৪৩৭ জনকে মেরে ফেলা হয়। ১০ জন পালিয়ে বাঁচেন।
আতঙ্কমাখা চোখে নিজু বললেন, 'আমার মা শান্তিদেবী (৭৮) সেদিন ট্রেনটি ফেল করায় এখনও জীবিত থাকলেও বিগত ৪৩ বছর ধরে জীবন্মৃত। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন।' নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় প্রায় সবাইকেই। কয়েকজন পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। তাঁরাই ওই নৃশংসতার সাক্ষী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই গণহত্যার নাম রেখেছিল ‘অপারেশন খরচাখাতা’। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে 'গোলাহাট গণহত্যা' নামে পরিচিত।
সেদিন বেঁচে যাওয়া তপন চন্দ্র দাস ওরফে কাল্টু দাস বর্তমানে জরি-বুটির দোকান করেছেন সৈয়দপুর শহরের শহিদ ডা. জিকরুল হক সড়কে। তিনি বলেন, ১৩ জুন পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের কথায় সরল বিশ্বাসে ট্রেনে উঠেছিলেন। কিন্তু শহর থেকে বেরিয়ে রেলওয়ে কারখানা পার হয়ে গোলাহাটে হঠাৎ থেমে যায় ট্রেনটি। বন্ধ জানালা একটু ফাঁক করতেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে। বাইরে রাইফেল হাতে সারি সারি সেনা। সঙ্গে চকচকে রামদা হাতে তাদের দোসর বিহারিরা।
তিনি আরও বলেন, থেমে থাকা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকেই চিৎকার করে পাকিস্তানি সেনারা উর্দু বলতে থাকে, ‘একজন করে নেমে আসো। তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলব, কিন্তু দামি গুলি খরচ করা হবে না। সবাইকে এক কোপে বলি দেওয়া হবে। তারপরই শুরু হয়ে যায় বেপরোয়া সেই হত্যাযজ্ঞ।
শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবাইকে কোপাতে থাকে তারা, এমন বিভীষিকাময় স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, বাইরে যাদের কোপানো হচ্ছিল, তাদের চিৎকার শুনে অনেকে ট্রেন থেকে নামতে চায় না। তখন ওরা ভেতরে ঢুকে কোপাতে শুরু করে। তখন আমি একটি জানালা খুলতে পেরে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে বাঁচি। অল্প যে কয়েকজন সেদিন বাঁচতে পেরেছিল, তারা ভারতে চলে যায়।