বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতীয় দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল একটি ভূখণ্ড, যার নাম বাংলাদেশ। সবুজ জমিমে রক্তিম সূর্যখচিত মানচিত্রের দেশটির স্বাধীনতার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আজ।
৫০ বছর আগে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি লাভ করে বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনই হল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে মুক্তির ইতিহাস—স্বাধীনতার ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান আর ২ লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং কোটি কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের গৌরবগাথা, গণবীরত্বের ইতিহাস।
ইতিহাস বলছে, দুই পাকিস্তানের (পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান) স্বাধীনতার পর আট মাসও অতিক্রান্ত হয়নি , পাকিস্তানের রাজধানী ( তৎকালীন করাচি) থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা) ঢাকায় উড়ে এলেন। মার্চে (১৯৪৮) জনসভায় ভাষণে ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানেরও।
জিন্নাহ নিজে উর্দুভাষী নন। পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ ভাগ মানুষও উর্দু বলে না। পূর্ব ০১ ভাগও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা বাংলা। জনসংখ্যাও পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
ইসলাম ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ধুয়ো তুলে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম) প্রতিষ্ঠা। জিন্নাহ’র বিশ্বাস, উর্দুর ক্ষেত্রেও এই ধুয়ো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হা করে গিলবে। কার্জন হলের ছাত্র সমাবেশেও একই কথা। প্রতিবাদ রেসকোর্সে, কার্জন হলেও। পরিণাম কী, ঠাওর করতে পারেননি। ভাষার প্রশ্নেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু। বীজ বপন জিন্নাহ’র। বীজ থেকে মহীরুহ। মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১৯৪৮ সালের মার্চে রেসকোর্সে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ভাষণ, জনগণ উপেক্ষা করেছে, থোড়াই কেয়ার করেছে দ্বিজাতিতত্ত্ব। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, রেসকোর্স ময়দানে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক। সর্বাত্মক সংগ্রামের প্ররোচনা, আহ্বান । বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘…এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ বেলা দু’টোয় ১৯ মিনিটের ভাষণ। ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ঘরে, মাঠপ্রান্তরে।
ইতিহাসের নির্মম রসিকতা নাকি নিয়তির প্রহার? যে রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর ভাষণ, ওই রেসকোর্সেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ৭ই মার্চে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার। রেসকোর্সেই পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে।
পাকবাহিনীর মূল জেনোসাইড (গণহত্যা) শুরু ২৫ মার্চের রাত ১২টার পরে। অর্থাৎ ২৬ মার্চ (ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে) থেকে। এই দিনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ঘোষিত। পাক সেনার আত্মসমর্পণ ১৬ই ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। ঠিক যে, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার দাবি ও আন্দোলনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার গোড়াপত্তন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর, বিশ্বে উন্নত মস্তক হোক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভেঙে যায়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হয় বাংলাদেশের জন্ম।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীর আলোতে একই সঙ্গে উদ্ভাসিত বাংলাদেশ। যেন অদ্ভুত সমাপতন। এ কথা তো সত্যি যে, মুজিবের মতো নেতা ছাড়া বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সাহসী চেতনার বিস্তার হত না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পাঠিয়েছিল, মানুষ বীরদর্পে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছিল চেতনায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ত্রিশ লক্ষ জীবন উৎসর্গকারী সেই যুদ্ধ নিয়ে এসেছিল গৌরবময় বিজয়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের এই সংযোগ বাংলাদেশের কাছে, বাঙালির কাছে যেন এক মাহেন্দ্রক্ষণ। দুটো ঘটনাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ঐতিহ্যের দিশা হয়ে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়াবে অগ্নিশিখার আলো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নাম করতে হবে ভারতীয় সেনার। আর অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। কোন পথে সেই জয় এনে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী? ঘটনার সূত্রপাত ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জয় লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ। তবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের মসনদে বসে থাকা রাজনৈতিকরা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এদিকে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেই সময় প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। এত সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে চলে আসায় সেই সময় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে দেশের অর্থনীতির উপর। এরই মাঝে পাকিস্তানকে ভারতে আসা শরণার্থীদের সুরক্ষিত ভাবে ফিরিয়ে নিতে বলেন ইন্দিরা গান্ধী। তবে সেই আলোচনা ভেস্তে যায়। আর ৩ ডিসেম্বর ভারতের উপর আক্রমণ করে পাকিস্তান।
সেই সময় ১৩ দিন ধরে যুদ্ধ হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। তবে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। এই পরিস্থিতিতে দেশের তিন সেনার প্রধানকে ইন্দিরা গান্ধী সবরকম স্বাধীনতা প্রদান করেন। ৩ ডিসেম্বর ভারতের উপর যখন পাকিস্তান আক্রম করেন, সেই সময় কলকাতায় ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আক্রমণের খবর পেয়েই তিনি দিল্লির উদ্দেশে রওয়ানা হন। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি রাজধানী থেকে ভাষণ দেন।
এর আগে প্রতিটি যুদ্ধেই ভারত রক্ষণাত্বক মনোভাব দেখিয়েছিল। যার জেরে পাকিস্তানের মধ্যে এই ভাবনা সুদৃঢ় হয়েছিল যে ভারত পাকিস্তানের থেকে দূর্বল। তবে পাকিস্তানের সেই মনোভাবকে চূর্ণ করে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারত আক্রমণাত্বক অবস্থান গ্রহণ করে। এর ফলে যুদ্ধ শুরুর ১৩ দিন পর পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। ভারতের সেই যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বকে কুর্নিশ জানিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী ইন্দিরাকে দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে।