বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে গত এক দশকে যত গর্ব করা হয়েছে, আজ তার সবটাই প্রশ্নের মুখে। করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই একের পর এক নীতিগত ভুল, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর বৈশ্বিক অস্থিরতা—এই তিনে মিলেই দেশের অর্থনীতিকে টেনে এনেছে গভীর সঙ্কটে। এখনকার বাস্তবতা এমন, যেটা শুধু সংখ্যায় বোঝানো যায় না, মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে সেই হতাশা। আর এহেন পরিস্থিতিতেই আজ অর্থাত্ সোমবার বাজেট পেশ করছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
'প্রথম আলো'-র খবর অনুযায়ী, ২০২৫ সালের বাজেট পেশ হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন জিডিপি বৃদ্ধির হার গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য করোনার সময় বাদ দিলে। দেশে বিনিয়োগও এখন এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। টানা তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি, অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে, কিন্তু মানুষের আয় সেই তুলনায় বাড়ছে না।
জিডিপি বৃদ্ধির হার ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যদি করোনাকালের বিশেষ পরিস্থিতি বাদ দেওয়া হয়। যেখানে একসময় ৭-৮ শতাংশে পৌঁছত, সেখানে এখন তা স্থবির প্রায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতার সবচেয়ে বড় চিহ্ন হচ্ছে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। সরকারি বিনিয়োগ কমেছে ব্যয় সঙ্কোচনের কারণে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বিনিয়োগ না থাকলে উৎপাদন বাড়ে না, কর্মসংস্থানও হয় না—এই সরল হিসেবটাই এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে।
টানা তিন বছর উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি
টানা তিন অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে লাগাতার। ফলে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অনেকটাই। গবেষণা বলছে, গত ৩৯ মাস ধরে শ্রমিক-মজুরদের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। ফলে প্রকৃত আয় কমছে। একই আয় দিয়ে আগের মতো জিনিসপত্র কেনা যাচ্ছে না।
কর্মসংস্থান হ্রাস, শ্রমবাজারে চাপ
বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে গত ৯ মাসে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কর্মসংস্থান কমেছে সেবা, কৃষি ও শিল্প—তিন খাতেই। সবচেয়ে বেশি কমেছে সেবা খাতে (২.৬%), তারপর কৃষি (২.৩%) এবং শিল্প (০.৮%)। ফলে শ্রমবাজারে সঙ্কট প্রকট হচ্ছে।
কৃষি উৎপাদনেও ভাটার টান
দেশের কৃষি উৎপাদনের হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত। এতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে ঋণপ্রদানে অনীহা দেখা দিচ্ছে ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
চরম দারিদ্র্যে ঝুঁকিতে ৩০ লাখ মানুষ
বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যেই অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। এর কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি।
নতুন বাজেট পেশের আগে কঠিন বাস্তবতা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা একসঙ্গে চলছে। নির্বাচনের আগে বা পরে বাজেট বাস্তবায়নের সুযোগ কতটা থাকবে, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।