বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর ঘনিয়ে আসছে বড়সড় সঙ্কটের মেঘ। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (IMF)-এর কাছ থেকে চাওয়া ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের পরবর্তী কিস্তি নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি। গত ৬ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় IMF-এর প্রতিনিধি দল এবং বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বৈঠক চললেও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। IMF সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বাংলাদেশকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, এক, ট্যাক্স-GDP রেশিও বাড়াতে হবে, দুই, টাকার বিনিময় হার আরও ‘ফ্লেক্সিবল’ করতে হবে।
IMF-এর তরফে স্পষ্টতই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সময় আর বেশি নেই। এই বার্তাকে ঢাকার নীতিনির্ধারকেরা ‘চূড়ান্ত সতর্কতা’ হিসেবেই দেখছেন। পরবর্তী আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে ওয়াশিংটনে IMF ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের স্প্রিং মিটিংয়ের সময়।
অর্থনীতি চাপে, বাড়ছে অসন্তোষ
IMF-এর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাগিওর্জিও স্বীকার করেছেন যে, দেশের অর্থনীতি ‘গভীর সমস্যার’ মধ্যে রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের GDP বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.৩ শতাংশ, যেখানে আগের বছর এই হার ছিল ৫.১ শতাংশ। একইসঙ্গে, মার্চ মাসে দেশের মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছেছে ৯.৪ শতাংশে, যা বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ৫-৬ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই বেশি। রয়েছে জ্বালানি ঘাটতি, বিদ্যুৎ সঙ্কট, রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং পোশাক রফতানির গতি কমে যাওয়া—এই সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে উঠছে। পাশাপাশি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নেমে এসেছে ২১.৮ বিলিয়ন ডলারে, যা দিয়ে বাংলাদেশ মাত্র ৩.৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে।
IMF-এর শর্ত: কর-ব্যবস্থায় সংস্কার
IMF-এর দাবি, বাংলাদেশের কর আদায়ের হার খুবই কম। কর আদায়কে জিডিপির অনুপাতে অন্তত কিছুটা বাড়াতে হবে। এখনকার কর কাঠামো স্বচ্ছ নয়, কর ফাঁকি বড় সমস্যা। উপরন্তু, IMF চাইছে টাকার বিনিময় হার আরও বাস্তববাদী হোক—অর্থাৎ বাজারের উপরে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এত বড় একটা রদবদল নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও আমলাতন্ত্র দ্বিধান্বিত।
শর্ত না মানলে মিলবে না কিস্তি
ঢাকায় এক সাংবাদিক বৈঠকে IMF-এর রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ জয়েন্দু ডে জানিয়েছেন, 'যদি সব কিছু ঠিকঠাক চলে, তাহলে জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তি দেওয়া যেতে পারে।' কিন্তু তার আগে বাংলাদেশকে কিছু জরুরি সংস্কার করতে হবে। যেমন—বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে আরও স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ করে তুলতে হবে। অর্থনৈতিক খাতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। অর্থাৎ, শর্ত মানতেই হবে।
আরও লোন চাইছে বাংলাদেশ
IMF ছাড়াও বাংলাদেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB), এবং জাপানের উন্নয়ন সংস্থা JICA-র দিকে। আপাতত পাকিস্তানের মতো চরম বিপর্যয়ের মুখে না হলেও, পরিস্থিতি যদি এখনই সামলানো না যায়, তাহলে সেই দিকেই এগোতে পারে দেশের অর্থনীতি।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিদেশি ক্ষোভ
অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পরে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা টালমাটাল। একই সময়ে কর কাঠামো ও বিনিময় হার নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা IMF-কে আরও সজাগ করে তুলেছে।
এছাড়াও, বাংলাদেশের তরফে সম্প্রতি পাকিস্তানের কাছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং ৪.৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করার ঘটনাও আন্তর্জাতিক স্তরে চর্চার বিষয়। IMF বারবার বলছে, এটাই শেষ সুযোগ। বাংলাদেশকে এখনই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে হবে, নয়তো ভবিষ্যতে এই ধরনের আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ওয়াশিংটনে আগামী বৈঠকে এই দিকেই নজর থাকবে বিশ্ব অর্থনীতির সব বড় খেলোয়াড়দের।