আগামী বছর বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। তার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। একদিকে অধ্যাদেশ জারি করে আওয়ামী লিগ নেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ বন্ধ করেছে বাংলাদেশের মহম্মদ ইউনূস সরকার। সেইসঙ্গে আগের সরকারের যে সব প্রধান নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে চার্জ গঠন করা হচ্ছে বা হয়েছে, তাঁরাও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এসবের মধ্যেই ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তার মিত্রদের মধ্যে মতবিরোধ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্য
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কিছু ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে তাঁর ওই মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে, তেমনি কিছু প্রশ্ন ও উদ্বেগও তৈরি করেছে। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেফ এগজিটের (নিরাপদ প্রস্থান) কথা ভাবছে। ওই সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে অথবা গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিট্রে (প্রতারণা) করেছে। যখন সময় আসবে, তখন আমরা এদের নামও উন্মুক্ত করব।’
নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য থেকে অধ্যাপক মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সম্পর্কে মোটাদাগে দুটি ‘অভিযোগ’ পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমত, অনেক উপদেষ্টা সরকারে থাকার সুবাদে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। দ্বিতীয়, উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনের পর নিজেদের সেফ এগজিটের কথা ভাবছেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলছেন
বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট থেকে নাহিদ ইসলামের এ বক্তব্যের ভিডিও ও ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এবার মুখ খুললেন বাংলাদেশের পরিবেশ এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই বিষয়গুলো নাহিদকেই পরিষ্কার করতে হবে বলে স্পষ্ট করেছেন রিজওয়ানা। নিজের অবস্থান জানিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আমি একদম কোনও ‘এগজিট’ খুঁজছি না, দেশেই ছিলাম, এর আগেও বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা এসছে। ওসব ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিহত করে দেশে থেকেছি। বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটিয়ে যাব আপনাদের সঙ্গে।
সারজিস আলম বলছেন
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘কিছু উপদেষ্টার মধ্যে আমরা এই আচরণ দেখতে পাচ্ছি যে তাঁরা এখন কোনওভাবে দায়সারা দায়িত্বটা পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এগজিট নিতে পারলেই হলো।’ সারজিস আলমের আরও বক্তব্য, ‘এই দায়সারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অভ্যুত্থান–পরবর্তী একটা সরকার কাজ করতে পারে না। তাঁরা এত শহিদের ওপর, এত রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ওইখানে আছেন। তাঁরা যদি এখন জীবনের একটু থ্রেটের ভয় করেন, তাহলে তো ওই দায়িত্ব তাঁদের নেওয়া উচিত ছিল না।’ সারজিস আলম বলছেন ‘তাই স্পষ্ট কথা, তাঁরা যদি এত কিছু, এত বড় ত্যাগ এগুলোকে ভুলে গিয়ে শুধু ওইটুকু চিন্তা করেন, সবাই না গুটি কয়েক, তাঁরা যদি ওইটুকু চিন্তা করেন এবং ওইভাবে নেগোশিয়েশনের ভিত্তিতে আগামীতে কারা ক্ষমতায় আসবে, ওইটাকে চিন্তা করে তাঁদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আমরা মনে করি দেশের মানুষের সামনে তাঁরা মুখ দেখাতে পারবেন না। কোথায় সেফ এক্সিট নেবেন, পৃথিবীতে সেফ এগজিট নামের একটাই জায়গা, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। এ ছাড়া কোনো সেফ এগজিট নেই। আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তে যান, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে ধরবে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হোক, সামনাসামনি হোক।’
প্রসঙ্গত, চলতি বছর মার্চেই বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া দলটির নেতারা ঘোষণা করেন, তারা অন্য কোনও দেশ নয়, তারা হবেন বাংলাদেশপন্থি। তাদের লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর তা পূরণে নতুন সংবিধান প্রণয়নে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চান জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নায়করা। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের উদ্যোগে গঠিত এনসিপির ঘোষণাপত্রে এসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাই এনসিপি তৈরি করেছিলেন। মূলত তাঁদের প্রচেষ্টাতেই হাসিনা সরকারের পতনের পর মহম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হয়েছিল। ইউনূস নাহিদ ইসলাম সহ তিনজন ছাত্র প্রতিনিধিকে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদ বা মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে নাহিদ এনসিপির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পদত্যাগ করলেও, আরও দু'জন উপদেষ্টা হিসেবে রয়ে যান।