দীপু চন্দ্র দাস বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার ভিতর থেকে টেনে হিঁচড়ে দীপু চন্দ্র দাসকে বাইরে নিয়ে আসে উন্মত্ত জনতা। এরপর চলে নৃশংস অত্যাচার। জানা গিয়েছে, ২৭ বছর বয়সী ওই হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা এখনও অস্পষ্ট এবং প্রমাণিত নয়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বলেই মনে করছে।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (RAB) ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টে নাগাদ কারখানার ভিতরেই উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ ও কোয়ালিটি ইনচার্জ দীপুকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এরপর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরিবর্তে উত্তেজিত একদল ইসলামপন্থী জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। RAB ১৪-এর কমান্ডার নাইমুল হাসান বলেন, 'ধর্ম অবমাননার অভিযোগটি অত্যন্ত অস্পষ্ট। দীপু আসলে কী বলেছিলেন তা কেউই পরিষ্কারভাবে বলতে পারেনি। কোনও প্রমাণও পাওয়া যায়নি।' তদন্তে উঠে এসেছে, শিফট পরিবর্তনের সময় অন্য শিফটের শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে পরিস্থিতি আরও বেগতিক করে তোলে। রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে উত্তেজিত জনতা কারখানার গেট ভেঙে নিরাপদ কক্ষ থেকে দীপুকে টেনে বের করে আনে। পরে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তার মরদেহ ঢাকা-ময়মনসিংহ জাতীয় সড়কের মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং আগুন ধরানো হয়।
পুলিশকে দেরি করে খবর
পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠার পরও কারখানা কর্তৃপক্ষ সময়মতো পুলিশকে জানায়নি। পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট মহম্মদ ফারহান হোসেন খান বলেন, 'ঠিক সময়ে একটি ফোন কল পেলেই দীপুকে বাঁচানো সম্ভব হত।' এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ, কোয়ালিটি ইনচার্জ ও একাধিক শ্রমিক রয়েছেন। সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিও পর্যালোচনা করে এই গ্রেফতারি হয়েছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, পরিস্থিতি শান্ত করতে দীপুর ভুয়ো পদত্যাগপত্র তৈরি করা হয়েছিল। বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, এটি আসলে দীপুকে জনতার হাতে তুলে দেওয়ারই একটি ধাপ ছিল, যাতে কারখানায় হামলা না হয়।
পুলিশ ও র্যাব স্পষ্ট করেছে, দীপু চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার কোনও প্রমাণ মেলেনি। এমনকী সোশ্যাল মিডিয়াতেও এমন কোনও পোস্ট পাওয়া যায়নি।
দীপুর ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস বলেন, 'সে যদি কোনও অপরাধ করেও থাকত, আইন অনুযায়ী বিচার হতে পারত। কিন্তু তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।'
৩ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল দীপুর। রয়েছে এক দেড় বছরের সন্তানও। তদন্তকারীদের মতে, দীপুর হত্যা কোনও আকস্মিক জনরোষ নয়। বরং এটি ছিল কয়েক ঘণ্টা ধরে ধাপে ধাপে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড। পুলিশের কাছে দেরিতে খবর দেওয়াও পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের প্রশ্ন, পুলিশও কি ওই উন্মত্ত জনতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল? কারা ন্যায়বিচার দেবে তাহলে দীপুকে?
বিশ্বাসঘাতকতা সহকর্মীদের?
দীপু চন্দ্র দাসকে কারখানার নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়েছিল এবং রাত ৮টা নাগাদ পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। কারখানার সিনিয়র ম্যানেজার বলেন, 'কারখানার অভ্যন্তরে আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বিষয়টি সমাধানের জন্য যথাসাধ্য করেছি। ততক্ষণে কারখানার শিফট পরিবর্তনের সময় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় শিফটের শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। তাছাড়া খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রা সেখানে জড়ো হয়ে যায়। রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে উন্মত্ত জনতা কারখানায় প্রবেশ করে। কারখানার দরজা ভেঙে দেয় এবং নিরাপদ স্থানে ঢুকে দীপুকে টেনে নিয়ে যায়।' কারখানা সূত্রে দাবি, আক্রমণকারীরা দীপুকে কারখানা থেকে টেনে বের করে আনে। স্থানীয়রাও সেই জটলায় যোগ দেয়। ঘটনাস্থলেই তাঁকে হত্যা করা হয় এবং শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ময়মনসিংহে ব়্যাব-১৪ কোম্পানি কমান্ডার মহম্মদ শামসুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ায় কারখানা বাঁচাতে তাঁকে জোর করে বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়।' তবে দীপুকে কারখানার অন্যান্য ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে সিনিয়র ম্যানেজার সাকিব মেহমুদ বলেন, 'আমরা কখনওই এমন কাজ করিনি।'