scorecardresearch
 

বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম, রক্তের বিনিময়ে অক্ষর, যে পথে হেঁটেই মুক্তিযুদ্ধ

সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ ছিল বাংলা ভাষাভাষী। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডাক বিভাগের খাম, পোস্টকার্ড ও অন্যান্য সরকারি ফর্মে ইংরেজির সঙ্গে শুধু উর্দু লেখা থাকায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার প্রতিবাদে প্রথমে খুব ছোট আকারে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ঢাকার প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির বাঙালি কর্মচারীরা। অবিলম্বে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও যুবসমাজ।

Advertisement
International Mother Language Day International Mother Language Day
হাইলাইটস
  • আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
  • স্বাধীন বংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য
  • এবারও করোনা আবহে ভাষা বীরদের শ্রদ্ধা জানাতে শহিদ মিনারে ঢল

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি হচ্ছে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।  ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলন সুসংহত হয় এবং অগ্রগতি লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাই জনগণের মধ্যে পরবর্তীকালে বাংলাদেশে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।

 বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য বহুমাত্রিক: সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। স্বাধীনতার সময়ে, মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে উপমহাদেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা দুটিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম লিগকে ভোট না দিলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সম্ভব হত না।

স্মৃতির সরণি পেরিয়ে আজ ফের এক ২১ ফেব্রুয়ারি হাজির। ঝরেছিল রক্ত ৷ বিক্ষোভ মিছিলে কেঁপে উঠেছিল গোটা বাংলাদেশ ৷ শেষমেশ জিত হল সত্যের ৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা পেল নতুন পরিচয় ৷ ‘বাংলা’ ভাষার মোড়কে ঢেকে গেল গোটা বাংলাদেশ ৷ শহিদদের সেই অবদান এখন বিশ্বস্বীকৃত৷ বাংলাদেশের আঙিনা থেকে বেরিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন সারা পৃথিবীর ৷ বিশ্বের সকল দেশ ও জাতির ৷ ২১ ফেব্রুয়ারি সকল জাতির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দিন ৷ তাই এই দিন আন্তজার্তিক ভাষা দিবস ৷ ৫২-র ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের স্মরণেই রাষ্ট্রসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩ টি স্বাধীন দেশ দিবসটি পালন করে ৷

ঠিক ৫০ বছর আগে ব্রিগেড কেঁপেছিল "জয় ভারত ,জয় বাংলা"য়, আজও অমলিন ইন্দিরা-মুজিবুরের যুগলবন্দির রেকর্ড

 সেই ইতিহাস কিন্তু ছিল বড় কঠিন। সুদীর্ঘ প্রায় দুইশ’ বছর ব্রিটিশদের অপশাসন ও কুশাসনের অবসান ঘটার পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হলেও শুধু ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আদর্শগত কোনো যোগসূত্র ছিল না বললেই চলে। মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, উভয় অঞ্চলের মধ্যকার ভাষাগত বিরোধ।

Advertisement
মুক্তি যুদ্ধেও রয়েছে ভাষা আন্দোলনের আবদান
মুক্তি যুদ্ধেও রয়েছে ভাষা আন্দোলনের আবদান

সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ ছিল বাংলা ভাষাভাষী। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডাক বিভাগের খাম, পোস্টকার্ড ও অন্যান্য সরকারি ফর্মে ইংরেজির সঙ্গে শুধু উর্দু লেখা থাকায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার প্রতিবাদে প্রথমে খুব ছোট আকারে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ঢাকার প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির বাঙালি কর্মচারীরা। অবিলম্বে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও যুবসমাজ। এর মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলি জিন্না ঘোষণা করে দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা— অন্য কোনও ভাষা নয়। তবে জিন্না এ কথাও বলেছিলে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা কি হবে তা এই প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেন্বরে পূর্ব বাংলায় ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তমুদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেম। আর সেই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটা পরতে পরতে প্রত্যক্ষ করা যায়। যার সার্থক ফসল আজকের  স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। রক্তের দামে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি আর তার সিঁড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। গর্ব আর শোকের এই দিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে,  বাংলাদেশে এবার যার সূচনা হয়েছে  শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এসেছে মহামারির আবহে। তাই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের আয়োজনটি এবার হয়েছে সীমিত পরিসরে।

ভাষা শহিদদের স্মরণ
ভাষা শহিদদের স্মরণ

মুখের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে বিরল ইতিহাস গড়েছে বাঙালি। প্রাণের ভাষা বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে ওঠা দুর্বার আন্দোলনে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিক প্রমুখের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। যার ফলে বাংলা ভাষা পায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান একুশের শহীদদের আত্মত্যাগ বিশ্বসভায় পেয়েছে অনন্য মর্যাদা।

Offbeat Bangladesh: অজানা ওপার বাংলা! ভ্যাকসিন নিয়ে ঘুরে আসুন এই জায়গাগুলিতে

একুশ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির প্রথম দাবি করা হয় ১৯৯৭ সালে ৷ ভাষা শহিদ আব্দুল জব্বরের জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলার গফুরগাঁও উপজেলা থেকে উঠেছিস এই দাবি ৷ সে বছর স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গফুরগাঁও থিয়েটার’ ঐ দাবির পক্ষে শোভাযাত্রা বের করে ৷ এলাকার বিভিন্ন দেওয়াল, বাস ও ট্রেনে পোস্টার লাগানো হয় ৷ এর দু’বছর পর ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস চাই, একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই’ স্লোগানও তোলেন তাঁরা ৷ ১৯৯৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রসংঘের মহাসচীব কফি আন্নানের কাছে এই মর্মে আবদেনও করা হয় ৷ এরপর এই আবেদন নিয়ে চলে আলোচনা ৷ কখনও তা বাংলাদেশের সংসদের ভিতর, কখনও বিশ্বের দরবারে ৷ জল অনেক দূর গড়িয়ে যাওয়ার পর শেষমেশ ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রসংঘের ৩০তম অধিবেশনে প্রস্তাবটি ওঠে ৷ ২০০৮ সাল থেকে রাষ্ট্রসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলি একযোগে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তজার্তিক ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে ৷

Advertisement

প্রতি বছর বাংলাদেশে একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের তরফ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালির শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। মহামারির মধ্যে এ বছর তাদের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তাদের সামরিক সচিবরা। রাষ্ট্রপতির পক্ষে ফুল দেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম। আর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী। ভাষা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা বা রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।

 

Advertisement