খালেদা জিয়া মঙ্গলবার সকালে ঢাকার হাসপাতালে জীবনাবসান হয়েছে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। এমন একটা সময়ে তাঁর প্রয়াণ হল যখন বাংলাদেশে সঙ্কটময় পরিস্থিতি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে, মৌলবাদ এবং হিংসা মাথাচাড়া দিয়েছে, সর্বোপরি দেশ প্রস্তুত হচ্ছে ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য। BNP তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে লিখেছে, 'খালেদা জিয়া মঙ্গলবার সকাল ৬টা নাগাদ প্রথম নমাজের ঠিক পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।' BNP-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলের চেয়ারপার্সনের প্রেস উইংয়ের কর্তা শামসুদ্দিন দিদারও দেশবাসীকে এই শোকসংবাদ জানিয়েছেন।
পুতুলের রাজনৈতিক অবস্থান
১৯৪৫ সালের ১৫ অগাস্ট অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খালেদা জিয়াকে স্নেহ করে সকলে 'পুতুল' বলেই ডাকতেন। বাংলাদেশে তাঁর রাজনীতির মূলেই ছিল ভারত বিরোধী বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশে সফররত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতেও অস্বীকার করেছিলেন। পরে জানিয়েছিলেন, যাত্রাপথে প্রাণের ঝুঁকি থাকায় তিনি সাক্ষাৎ এড়িয়েছিলেন।
জিয়াউরের স্ত্রী হিসেবেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি
খালেদা জিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাববন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৫ সালে তাঁদের বিয়ের পর খালেদা জিয়া তাঁর স্বামীর সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যান। তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে খালেদা জিয়া রাখেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে জিয়াউর রহমানের উপরই দায়িত্ব ছিল।
জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং খালেদা জিয়া ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফত রহমান। আরাফত রহমান ২০১৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
১৯৮১ সালের ৩০ মে তাঁর স্বামীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড খালেদার জীবন ওলোট-পালোট করে দেয়। সেই যন্ত্রণা তাঁরে রাজনীতিতে ঠেলে দেয়, যেখানে আর পিছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ ছিল না। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া তাঁর স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দল BNP-তে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি BNP-র চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি আমৃত্যু ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব
খালেদা জিয়া ৩ বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। তাঁর প্রথম মেয়াদ ছিল ১৯৯১ সালের। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন। এই সময়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক করে দেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হলেও তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১০ অক্টোবর ২০০১ থেকে ২৯ অক্টোবর ২০০৬-এর মধ্যে তাঁর তৃতীয় টার্মে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন।
'বেগমদের যুদ্ধ'
বাংলাদেশের রাজনীতি গত কয়েক বছরে দুই বেগমের সংঘর্ষের সাক্ষী থেকেছে। একদিকে খালেদা জিয়া রাজত্ব করছিলেন, অন্যদিকে শেখ হাসিনার আধিপত্য ছিল। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির সংজ্ঞা তৈরি করেছিল। যা 'বেগমদের যুদ্ধ' নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সালে খালেদা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তখন হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলে। ১৯৯৬ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর খালেদা প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে খালেদার প্রত্যাবর্তন এবং ২০০৪ সালে হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুনে ঘি ঢালে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়কালে খালেদা জিয়া দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হন। ২০১৮ সালে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালে করোনা অতিমারীর কারণে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়। তারপর থেকে তিনি বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হন।
ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সময়কাল
খালেদা জিয়ার পাকিস্তানি পটভূমি প্রায়শই তাঁকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এনে ফেলেছে। ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদকে খালেদা জিয়ার রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খালেদা জিয়ার ভারত বিরোধী অবস্থান থেকে অনুমান করা যায়, ২০১৩ সালের মার্চ মাসে যখন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ঢাকা সফরে ছিলেন, তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি। সে সময়ে দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল UPA সরকার। খালেদা বলেছিলেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। নিজের মেয়াদকালে ভারতের চেয়ে চিনের সঙ্গে তিনি সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে তিনি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিরও বিরোধিতা করেছিলেন। 'দাসত্ব চুক্তি' বলে অভিহিত করেছিলেন। খালেদা জিয়ার সরকার তিস্তার জলবন্টন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং অবৈধ অভিবাসনের মতো বিষয়গুলি নিয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘাতমূলক অবস্থান বজায় রেখেছিল। বরাবরই নয়াদিল্লি থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন বাংলাদেশের এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।