ঘরের সমস্যা না মিটিয়েই ভারতকে একঘরে করার পরিকল্পনা ফেঁদেছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। মাঠে মারা গেল সব প্ল্যান। ১৩ বছর পর বাংলাদেশে পৌঁছন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। বৈঠক করেন ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ উপদেষ্টার সঙ্গেও। কিন্তু সেই বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেই দুই দেশের মধ্যে তীব্র মতানৈক্য প্রকাশ্যে চলে এল। কূটনৈতিক চালে মুখ থুবড়ে পড়ল তারা।
৫৪ বছর পুরনো অমীমাংসিত সমস্যা একদিনে ঠিক হয়ে যাবে, এ আশা যেন পাকিস্তান না রাখে। বৈঠক শেষে ঠারেঠোরে এমনটাই বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশ।
ইশাক দারের এই বাংলাদেশ সফর নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল
ঢাকা থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত। প্রথমে এই বৈঠক গত এপ্রিল মাসে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায়, সে সময়ে পাক বিদেশমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করতে পারেননি।
এ যেন ঘরে ডেকে অপমান করা!
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে ভারতে চাপে ফেলতে চেয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু উল্টো মুখ পুড়ল তাদেরই। ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানীর পর, ১৩ বছরের ব্যবধানে এবার ঢাকা সফর করেন ইশাক দার। বাংলাদেশও ভারতকে একঘরে করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইশাক দারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ঢাকাতে। বন্ধুত্বের নতুন শুরু হিসেবেই দেখা হচ্ছিল এই বৈঠককে।
কিন্তু ইশাক দার বাংলাদেশ পৌঁছতেই ঢাকা কূটনৈতিক চাল বদলে ফেলল। পাক বিদেশমন্ত্রী পৌঁছনোর আগে বাংলাদেশে চর্চা চলছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া হবে কি হবে না। ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাক সেনার বিরুদ্ধে হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি মহিলাদের ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে কিছু বিষয়ে সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক সেনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলে পাকিস্তানকে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে বলেছিল বাংলাদেশ। এছাড়াও যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ, সম্পদের ভাগ দেওয়ারও দাবি জানায় ঢাকা। আর এই অমীমাংসিত বিষয়গুলির সমাধান হয়ে গিয়েছে বলে রবিবার বৈঠক শেষে ঘোষণা করে দেন ইশাক দার। পাক বিদেশমন্ত্রী দাবি করেন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে অমীমাংসিত তিন সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। তবে তৌহিদের বক্তব্য, সমস্যার সমাধান হয়নি। কেবল সমস্যাগুলি সমাধানের বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ইউনূসের বিদেশ উপদেষ্টা বলেন, 'আমি অবশ্যই একমত নই। একমত হলে তো সমাধান হয়ে যেত।' অর্থাৎ তৌহিদ যে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তা কথাতেই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মতানৈক্য
তৌহিদের পাশে দাঁড়িয়েই ইশাক বলেন, 'অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।' বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে 'এক পরিবার, দুই ভাই' বলেও সম্বোধন করেন তিনি। ইশাক আরও বলেন, '১৯৭৪ সালের নথি দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর জেনারেল পারভেজ মুশারফ বাংলাদেশে আসেন এবং প্রকাশ্যে খোলা মনে সমস্যাগুলির সমাধান করেন। দু'বার সমাধান হয়েছে অমীমাংসিত বিষয়গুলির। প্রথমে ১৯৭৪ সালে, তার পরে ২০০০ সালের শুরুতে। পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে যখন বিষয়টির সমাধান হয়েই গিয়েছে, তখন দু’দেশকেই এগিয়ে যেতে হবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে।'
তবে তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সমস্যার কোনও সমাধান এখনও হয়নি। বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা চাই, হিসাবপত্র হোক, টাকাপয়সার ব্যাপার সমাধান হোক। আমরা চাই, এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করুক, ক্ষমা চেয়ে নিক। আমরা চাই, আটকে পড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নেবে। আমি বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত ভাবে তুলে ধরেছি।' ইশাকের দাবি প্রসঙ্গে তৌহিদের মন্তব্য, 'আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আমরা আমাদের অবস্থান বলেছি। ওঁরা ওঁদের অবস্থান তুলে ধরেছেন।'