কোটা বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ। আন্দোলনকারীদের দমন করতে লাঠিচার্জ করছে পুলিশ, কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটাচ্ছে, এমনকী গুলি চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে একাধিকজনের। আহত কয়েকশো। বাংলাদেশ পুলিশ কড়া হাতে আন্দোলনকারীদের দমন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল, ব্যারিকেড করে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে শেখ হাসিনার দেশের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী। তারা গুলিবিদ্ধও হয়েছে। তবে আন্দোলন থামার নাম নেই। মীরপুর, নারায়ণগঞ্জ, মদনপুর, মানিকগঞ্জ, রংপুর, ব্রাহ্মণবেড়িয়া, মাদারিপুর, গাজিপুর,রাজশাহি, ঢাকা, চট্টোগ্রাম-সব জায়গায় হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
আন্দোলনের প্রভাব এতটাই বেশি পড়েছে যে কোথাও বাস বন্ধ হয়েছে, কোথাও ট্রেন চলাচলও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, কবে জনজীবন ছন্দে ফিরবে এসব এখনই বলা যাচ্ছে না। বরং, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে পারে। আবার কারও মতে, শেখ হাসিনার সরকার এই আন্দোলনে ভয় পেয়েছে। সেই কারণে তারা হয়তো আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছে। তাই এত ধরপাকড়, সংঘর্ষ, মৃত্যু।
কোটা বিরোধী আন্দোলন কেন?
সরকারি চাকরিতে কোটা বা সংরক্ষণ অনেক দেশেই থাকে। আমাদের দেশেও রয়েছে। বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থা চালু সেই ১৯৭২ সাল থেকে। সময় যত বদলেছে কোটার অঙ্কও বদলেছে। কিন্তু এখন যে সংঘর্ষ, আন্দোলন হচ্ছে তার কারণ মেধাকে গুরুত্ব না দেওয়া-এই অভিযোগ করছেন আন্দোলোনকারীরা। তাঁদের দাবি বাংলাদেশে মেধার থেকে কোটা বা সংরক্ষণ প্রাধান্য পাচ্ছে। কোটার সুবিধে ভোগ করছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নাতি-নাতনিরা। তার জেরে সরকারি চাকরি সহ নানা ক্ষেত্রে মেধাবিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের বেকার থাকতে হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, কোটা সিস্টেম বাতিল করে মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের সুযোগ দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক বাড়াচ্ছেন শেখ হাসিনা। সেটা হতে দেওয়া চলবে না। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা চাকরিক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ সংরক্ষণ পাচ্ছেন। অথচ সংবিধানে সবার সমানঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাহলে সংবিধানকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে কোথায়?
এর আগেই জানিয়েছি, বাংলাদেশে কোটার অঙ্কটা বারবার বদলেছে। ১৯৭২ সাল থেকে কোটা সিস্টেম চালু হওয়ার পর থেকে এক এক বার এক এক রকম অঙ্কের সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সেটা কেমন এবার দেখুন। ১৯৭২ সালে যে কোটা সিস্টেম চালু করা হয় সেখানে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেত মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ। সেখানে কোটাতে মিলত ৮০ শতাংশ চাকরি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০ শতাংশ। ১৯৭৬ সালেও কোটা সিস্টেমে পরিবর্তন আসে। তখন মেধার ভিত্তিতে ৪০ শতাংশকে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ ৩০ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৯৭ সালে কোটার মধ্যে ঢোকানো হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের। এরপর আবার পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে। এতদিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা কোটা সিস্টেমে চাকরি পেতেন। তাঁদের জন্য ৩০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু এগারো সালে এই কোটার সুবিধে পেতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা।
কোটা আন্দোলন কীভাবে শুরু হল?
চলতি জুন মাস থেকেই যে কোটা আন্দোলন শুরু হয়েছে এমনটা নয়। এই আন্দোলন বাংলাদেশে প্রথম শুরু হয় ২০১৮ সালে। সেই বছর কোটা সিস্টেম বাতিলের আবেদন করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তিনজন। তা খারিজ করে দেয় আদালত। তারপরই ফেসবুকে 'কোটা সংস্কার চাই’ নামে একটি পেজ খোলা হয় এবং শাহবাগকে কেন্দ্র করে পেজটি থেকে একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই সময় বাংলাদেশে আন্দোলনও হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা করেন। এদিকে ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে যান। তাঁরা কোটা সিস্টেম চালু করার আবেদন জানান। হাইকোর্ট তাতে সম্মতি দেয়। অর্থাৎ ফের আগের কোটা সিস্টেম চালু হয়ে যায়। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করে সরকার। তবে গত ১ জুলাই থেকে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরইমধ্যে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু হয় বাংলাদেশে।
আন্দোলনকারীরা কেন কোটা বা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে?
প্রথম কারণই হল মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা সংরক্ষণের আওতায় আসুক এটা বাংলাদেশের একাংশ চাইছে না। তাঁদের যুক্তি, সংরক্ষণের সুবিধে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানরা পেয়েছেন। নাতি-নাতনিদের কেন দেওয়া হবে? এটা আসলে মেধাবীদের বঞ্চনা করার সামিল।
দ্বিতীয় কারণ হল, কোটা সিস্টেমের ফলে আদৌ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার উপকৃত হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নও তাঁরা তুলছেন। আন্দোলনকারীদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা সামিল হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন কৃষক-মজুর। অথচ তাঁরা বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চাকরি পাননি।
তৃতীয়ত : আন্দোলনকারীরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের চাকরি দিয়ে এই সরকার একটা জেনারেশনকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এটা দেশের জন্য-দশের জন্য ক্ষতিকর।
এই আন্দোলন নিয়ে সরকার কী বলছে এবার জানাব। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়েছেন, কড়া হাতে আন্দোলন দমন করা হবে। বুধবার তিনি বলেন, 'যারা হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোটা আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। এর ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যা ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক।' অর্থাৎ শেখ হাসিনা বলছেন, আন্দোলন তিনি বরদাস্ত করবেন।
এদিকে শেখ হাসিনার এই বক্তব্য শুনে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, বাংলাদেশের সরকার এই আন্দোলনকে শুধু কোটা বিরোধী নয়, সরকার বিরোধী আন্দোলন হিসেবেও বিবেচনা করছে। সরকার মনে করছে, কোটা-কে সামনে রেখে আসলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলন করছে সরকার ও আওয়ামি লিগকে বিপাকে ফেলতে।
তাহলে যেটা দাঁড়াল,কোটা বিরোধী আন্দোলন এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তা বাংলাদেশের সরকারের জন্য আদৌ ভালো খবর নয়। সরকার আন্দোলন বাড়তে দিতে চায় না। আর আন্দোলনকারীরাও তাদের অবস্থান থেকে সরতে চান না। এখন দেখার আন্দোলনের জল আরও কতটা এবং কোন দিকে গড়ায়।