
সতীর একান্ন পীঠের মধ্যে অন্যতম মা যশোরেশ্বরী। কথিত আছে, সুদর্শন চক্রে খণ্ডিত হয়ে সতীর করকমল বা তালুদ্বয় পড়েছিল এখানে। অনেকে বলেন, দেবীর দু’টি পা পড়েছিল। সতীর দেহের কোনও অংশ এখানে পড়েছিল, তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত মন্দির এটি।
যশোরেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস
যশোরেশ্বরী নামের অর্থ 'যশোরের দেবী'। বলা হয় বঙ্গদেশের হিন্দু রাজা প্রতাপাদিত্য মানুষের হাতের তালুর আকারের একখন্ড পাথর অলৌকিকভাবে পেয়েছিলেন। যারপর মায়ের পুজোর জন্য যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন প্রতাপাদিত্য। যা নির্মাণ করেছিলেন আনাড়ি নামে এক ব্রাহ্মণ। তিনিই এই মন্দিরে ১০০টি দরজা তৈরি করেন। পরবর্তী কালে মন্দির সংস্কার করেন লক্ষ্মণ সেন ও রাজা প্রতাপাদিত্য। সেই সঙ্গে পাশেই তৈরি করা হয় নাট মন্দির। শোনা যায়, সেই সময়ে নাকি মায়ের নামে দান করা হয়েছিল প্রায় ২০০ বিঘা জমি। তবে আজ সবই হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু কয়েকটি স্তম্ভ।
মোদী দিয়েছিলেন মুকুট
৫০০ বছরেরও পুরনো এই মন্দিরে মা কালীর পুজো ঘিরে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান সব ধর্মের মানুষ। বাংলাদেশ সফরের সময় যশোরেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন ভারতের প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। শাড়িও নিবেদন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
কেমন এখানে মায়ের রূপ ?
এখানে মায়ের মুখটুকুই শুধু চোখে পড়ে।শ্রীযশোরেশ্বরীর বাকিটুকু কাপড়ে আবৃত। হাত বা পা শ্রীচরণ কিছুই নজরে পড়ে না। মায়ের মাথার ওপর টুকটুকে লাল রঙের চাঁদোয়া। মায়ের প্রিয় রক্তজবার মালা । তাই মাকে সকলে লাল জবাব মালা দিয়ে পুজো দেন। নানা অলংকারে ভূষিতা মা। মাথায় সোনার মুকুট নজর কাড়ে। অনেকেই বলেন, মালদার জাগ্রত জহুরা মায়ের সঙ্গেদেবীর সাদৃশ্য রয়েছে। এই মন্দিরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হয় নিত্য পুজো। এখানে কালী পুজো হয় বেশ ধুমধাম করেই। হয় ছাগ বলি। সমাগম ঘটে হাজার হাজার ভক্তের। এই মন্দিরে দেবী খুবই জাগ্রত বলে বিশ্বাস ভক্তদের।
সম্প্রীতির উদাহরণ
এ হেন মন্দিরকে নিয়ে রয়েছে আরও ইতিহাস। শোনা যায়, এক বার অম্বররাজ মানসিংহ এক পুরোহিতের সাহায্যে মায়ের বিগ্রহ চুরি করে নিয়ে গিয়ে রাজস্থানের অম্বর দুর্গে তা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার কয়েক দিনের মধ্যেই মায়ের রুষ্ট মূর্তি দেখে প্রতিমাকে সূক্ষ্মবতী নদীর তীরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ দিকে, যশোরেশ্বরী মন্দিরে মাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। এখন সেই মন্দিরে পুজো দিতে ভক্ত সমাগম ঘটে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। শুধু হিন্দুরা নন, এখানে মানত করতে আসেন মুসলিম ভক্তরাও। মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে মন্দিরের বারান্দা থেকে জোড়া পায়রা উড়িয়ে দেওয়ার রীতি আছে।
মন্দিরের পাশেই মসজিদ ও গির্জা
জনশ্রুতি, শুধু মন্দির নির্মাণ নয়। তৎকালীন সমাজে সৌহার্দ্যের বার্তাও দেন রাজা প্রতাপাদিত্য। মন্দিরের অদূরে নির্মাণ করান একটি মসজিদ ও একটি গীর্জা। মসজিদটির নাম টেঙ্গা মসজিদ। টেঙ্গা শব্দের অর্থ যুদ্ধ শিবির। মসজিদটি উৎসর্গ করেন তাঁর কর্মচারী কামালউদ্দিনের উদ্দেশে, যিনি প্রথম দেবীস্থানে অলৌকিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। তবে সময়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারেনি এই মন্দির। মুঘলরা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে এই রাজ্যের দখল নিলে যশোরেশ্বরী মন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলে। রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জনবসতিহীন হয়ে পড়ে এই এলাকা। প্রায় দেড়শো বছর পর, এই মন্দিরের পুরোহিত ও সেবায়েতদের বংশধররাই নতুনভাবে মন্দিরের সংস্কার করেন। একটা সময় ছিল, যখন কালী পুজোর দিনগুলোতে গমগম করত যশোরেশ্বরীর মন্দির। অবিভক্ত বাংলাদেশের দূর দূরান্ত থেকে জমিদাররা আসতেন পুজো দেখতে। পুজোর ক’দিন কাটাতেন এখানেই। এখনও কালীপুজোয় ভক্ত সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর।