Google-কে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, 'আমি যখন জন্মেছিলাম, বাবা (উস্তা আল্লারাখা) আমার কানে ফিসফিস করে যে মন্ত্রটি পাঠ করেছিলেন, তা ছিল একটি তাল।' সেই মন্ত্রটিই ছিল গুরুমন্ত্র। তবলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছনোর যে কাজ উস্তাদ আল্লারাখা শুরু করেছিলেন, জাকির তা শীর্ষে নিয়ে গিয়েছেন।
ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায় কি আল্লারাখার জনপ্রিয়তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন জাকির? প্রশ্নটা তুললে অত্যুক্তি হয় না।
হার্টের সমস্যা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সান ফ্রান্সিসকোর হাসপাতালে যখন ভর্তি হন, তখন তাঁর বেশ গুরুতর। গোটা বিশ্ব প্রার্থনা করেছে রবিবার রাতে, ভারতের এই রত্ন যেন দীর্ঘজীবী হন। কিন্তু শেষরক্ষ হল না। ভারত তথা বিশ্ব যেন বিশ্বাসই করতে চাইছিল না জাকির হোসেন নেই। মৃত্যুর খবর ঘিরে দীর্ঘ চর্চা শুরু হয়।
উস্তাদজি বেঁচে আছেন, এই খবরও দাবি করেন অনেকে। শেষ পর্যন্ত আজ অর্থাত্ সোমবার জাকির হোসেনের পরিবারের তরফে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। ৭৩ বছর বয়সে চিরঘুমে উস্তাদ।
আমৃত্যু ভারতকে গর্বিত করে গিয়েছেন জাকির হোসেন। ২০২৪ সালের গ্র্যামির মঞ্চেও জাকিরের হাত ধরেই ভারত দুটি গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছে। জাকির হোসেনের ফিউশন ব্যান্ড ‘শক্তি’ গ্র্যামির মঞ্চে সেরার শিরোপা পেয়েছে । ‘বেস্ট গ্লোবাল মিউজ়িক অ্যালবাম’ হিসাবে পুরস্কৃত ভারতীয় ব্যান্ড ‘শক্তি’র গানের অ্যালবাম ‘দিস মোমেন্ট’। ১৯৭৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে এই ‘শক্তি’ ব্যান্ড।
নেপথ্যে ছিলেন, ব্রিটিশ গিটারবাদক জন ম্যাকলফলিন, ভারতীয় ভায়োলিন বাদক এল শঙ্কর, তবলা বাদক জ়াকির হুসেন ও অন্য তালবাদ্যে টিএইচ (ভিকু) ভিনায়াক্রম। উত্তর ভারতীয় ও কর্ণাটকী মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্যাজ় এবং ব্লুজ় ধারার মিশেলে তৈরি হয় ‘শক্তি’-র সঙ্গীত।
তবলাকে সাধারণ মানুষের ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাকির হোসেন। তখন দূরদর্শনের জমানা। একটি চায়ের বিজ্ঞাপনে 'ওয়াহ উস্তাদ ওয়াহ!' শব্দবন্ধটির সঙ্গে জাকির হোসেন একাত্ম হয়ে যায় ভারতের সাধারণ মানুষের মনে।
১৯৫১ সালের ৯ মার্চ মুম্বইয়ে জন্মগ্রহণ করেন জাকির হোসেন। উস্তাদ আল্লারাখার বড়ছেলে। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে মুম্বইয়ে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে জাকির হোসেন প্রথমবার মঞ্চে ওঠেন। ডেবিউ পারফর্ম্যান্সেই প্রমাণ করে দেন, তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে জগত্ সভার স্রেষ্ঠ আসনে নিয়ে যাবেন।
জাকির হোসেনের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত গোটা বিশ্বের কোণায় কোণায় জাকিরের তবলার বোলে মুগ্ধ দুনিয়া।
৬ শতকের বেশি সময় ধরে তাল-লয় নিয়ে দুনিয়াদারি চালিয়ে গিয়েছেন। জাকিরের আঙুলগুলি যেন কথা বলত। ১৯৮৮ সালে পদ্মশ্রী,২০০২ সালে পদ্মভূষণ ও ২০২৩ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মান পান।
রাগ রাগিনী, তাল, লয়ের ব্যাকরণ সম্পর্কে যাঁদের বিন্দুমাত্র পড়াশোনা নেই, তাঁরাও মুগ্ধ হন জাকির হোসেনের আঙুল যখন তবলায় ঠোকে। সঙ্গীত বোদ্ধা না হয়েও যে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক, বিশেষ করে তবলায় ঈশ্বর দর্শন হয়, সাক্ষাত্ শিবের নটরাজ রূপ দর্শন সম্ভব, জাকির হোসেন তা প্রমাণ করেছেন বারবার। ঈশ্বর-আল্লা মিলেমিশে জাকিরের ধর্ম ছিল শুধুই সঙ্গীত। ওয়াহ উস্তাদ ওয়াহ!