
বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছিল অলোকেশ। কিন্তু সে নামে লোকে তাঁকে চিনল কোথায়! এক আত্মীয় আদর করে নাম দিয়েছিলেন বাপি। সেখান থেকে বাপ্পি। যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করেন, অলোকেশ লাহিড়ীকে চেনেন, বেশিরভাগ মানুষই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন। সেই একই ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, বাপ্পি লাহিড়ীকে (Bappi Lahiri) চেনেন? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাল্টে যাবে। অন্তত গোটা দেশে তো বটেই। দেশের বাইরেও তাঁকে মানুষ এই নামেই ডাকেন, বাপ্পি দা।
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়ি জেলায় জন্ম বাপ্পি লাহিড়ীর। ছোট থেকে সঙ্গীতের আবহেই বড় হয়েছেন। বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা অপরেশ লাহিড়ি আর মা বাঁশুড়ি লাহিড়ী দুজনেই বাংলা সঙ্গীত জগতে ছিলেন পরিচিত নাম। গানের হাতেখড়ি পরিবারেই। তিন বছর বয়স থেকে তবলা বাজাতে পারতেন বাপ্পি।
সঙ্গীত পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মুম্বই পাড়ি দেন গায়ক। ১৯৭৩ সালে নানহা শিকারি ছবিতে তিনি প্রথম সঙ্গীত পরিচলনা করেন তিনি। এর পর তাহির হুসেনের জখমি (১৯৭৫) ছবিতে কাজ করেন। অনেকেই জানেন না, মাত্র ১১ বছর বয়সে বাংলা ছবি দাদু-র একটি গান কম্পোজ করেছিলেন বাপ্পি। এতটাই তাঁর স্বকীয় প্রতিভা ছিল। ছেলের মধ্যে সম্ভাবনার দেখে বাবা-মাও তৎকালীন বম্বে-তে চলে যান।
জখমি-র গান হিট হওয়ায় ধীরে ধীরে পরিচিত পেতে শুরু করেন বাপ্পি। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুনীল দত্ত, আশা পারেখ, রাকেশ রোশন, রীনা রায়-সহ অনেকে। আশা ভোঁসলে এবং কিশোর কুমারের কণ্ঠে ছবির একটি গান অমরত্ব পেয়ে গিয়েছে, 'জ্বলতা হ্যায় জিয়া মোরা ভিগি ভিগি রাতোঁ মে...' রোম্যান্টিক অথচ নেচে ওঠার গান কম্পোজ করতে বাপ্পিদার জুড়ি ছিল না। তিনি এক কথায় ছিলেন ট্রেন্ড সেটার।
বাপ্পি-মিঠুনের যুগলবন্দি দেশে আরও এক নতুন ট্রেন্ডের জন্ম দেয়... ডিস্কো। ডিস্কো ডান্সার থেকে শুরু হওয়া সেই ট্রেন্ড রাতারাতি গোটা দেশকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কম্পোজ করা তো বটেই, তার সঙ্গে গানেও জাদু ছড়িয়েছিলেন বাপ্পি। 'ইয়াদ আ রাহা হ্যায়... তেরা প্যায়ার...'। আজও যে কোনও ডিস্কো প্লে লিস্টে বাপ্পি গাওয়া এই গান থাকবেই। এর পর এক এক করে মিঠুন-বাপি পার্টনারশিপে নানা ছবিতে ডিস্কোর জাদুতে মেতে ওঠে দেশ।
সেখান থেকেই বাপ্পি-র নাম ডিস্কো কিং হয়ে যায়। তবে এটা তাঁর জীবনের একটা অংশ মাত্র। নমক হারাম থেকে শরাবি, চলতে চলতে... এমন অসংখ্য ছবিতে অজস্র মেলোডি উপহার দিয়েছেন। আর কে ভুলতে পারবে 'অমর সঙ্গী'র টাইটেল ট্র্যাক। বাপ্পি অমর সৃষ্টির আরও একটি উদাহরণ এই গানটি। টলিউড সুপারস্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ফিল্ম কেরিয়ারে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং হিট গান কিশোর কুমারের গাওয়া এই গানটি।
কালো চশমা আর গলায় বেশ কয়েক ভরি সোনার হার, কেন সবসময় সোনার হার পরে থাকতেন বাপ্পি লাহিড়ী? এ প্রশ্ন করতেন অনেকে। উত্তর দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। বলেছিলেন, প্রথম সোনার চেন উপহার দিয়েছিলেন মা। এর পর স্ত্রী তাঁকে গণেশের একটি লকেট-সহ চেন উপহার দেন। তিনি মনে করেন, সোনা তাঁর জন্য বেশ পয়া। আর সে কারণেই সোনার প্রতি তাঁর অমোঘ টান ছিল।
গত বছর এপ্রিল মাসে করোনায় আক্রান্ত হন বাপ্পি। তার পর থেকেই তাঁর শরীরে নানা সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া-য় ভুগছিলেন। তার সঙ্গে ছিল ফুসফুসে সংক্রমণ। দীর্ঘ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর বাড়িতে ফিরে আসেন। কাজেও ফিরেছিলেন। কিন্তু শরীর মাঝে মধ্যেই জানান দিচ্ছিল, সে ভালো নেই। গত এক মাস যাবত মুম্বইয়ের সিটি কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছুটি দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু এক দিনের মধ্যেই ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মঙ্গলবার ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বুধবার ভোরে চলে গেলেন বাপ্পি লাহিড়ী।