'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে,
আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে!.....' সালটা ১৯৫২। কোচবিহারে খাদ্য আন্দোলন চলছে। অভুক্ত মানুষগুলো ভুখা মিছিল করছিলেন। সেই মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। মারা যায় এক কিশোরী। ভাতের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে বুলেট খেতে হয় কিশোরীকে। সব সুখ-স্বপ্ন বারুদের কাছে মাথা নত করে সে। চুপ করে থাকতে পারেননি কবি। তুলে নিয়েছিলেন কলম। লিখেছিলেন, 'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে,
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে !
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী-
দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দিই !
হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়
হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাত দিই হায়।' - এই কবিতা বাংলা প্রতিবাদী কবিতার বিশ্বে একঝলক নতুন বাতাস।
কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় বারবার জায়গা পেয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাধারণ মানুষ। তাঁর কবিতা যেন বোবার মুখে ভাষা জুগিয়েছে, মানুষকে দিয়েছে বিশ্বাস। তিনি প্রতিবাদী কিন্তু, আশাবাদীও। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাস পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় তাঁকে। সমালোচকরা বলেন, কবিতার গুণে তিনি শতক দশকের হিসেব ছাপিয়ে গিয়েছেন অনেক আগেই।
কবিতা মানে তো সৃষ্টি। আর সেই সৃষ্টি যে ব্যক্তিগত জীবন যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তার প্রমাণ পাওয়া যায় কবির জীবনচর্যা-যাপন থেকেও। তিনি যেন সংযমের প্রতীক। আর তেমনই তাঁর কবিতাগুলি। সেখানে প্রতিবাদ আছে অথচ চিৎকার নেই, হুঙ্কার নেই, শুধু উপস্থিতির মধ্যেই প্রাবল্য।
আসলে নিরবতারও ভাষা থাকে। সেটার থেকে বড় প্রতিবাদ আর কীই বা হতে পারে? কবি হিসেবে আজীবন এই কাজটিই করে গিয়েছেন এই শিল্পী। তাঁর কবিতায় চিৎকার নেই অথচ সে যেন নির্জনে এসে দাঁড়ায় জনতার মাঝে। হেঁটে যায় দৃপ্ত পদক্ষেপে। সে পরাজিত করে সমস্ত অকল্যাণকে। তাই তো তিনি লিখেছেন-
'এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে
স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।'
গণতন্ত্রকেও কখনও কখনও প্রহসন বলেও মনে করেছেন কবি। মধ্যবিত্ত মানুষকে ছাপোষা করে রাখার কলকে আঘাত করেছেন কবিতায়। তিনিই লিখেছেন, 'ন্যায় অন্যায় জানিনে। তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে! স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধ্বসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল সমাজবিরোধী।'
শুধু কবিতা কেন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও মুখর হতে দেখা গিয়েছে কবিকে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় রাজ্যে 'পরিবর্তন চাই'-এর বুদ্ধিজীবীদের প্রধান মুখ ছিলেন তিনি। নেমেছিলেন রাজপথে। রাজ্যে পরিবর্তনও হয়েছিল। কিন্তু, শাসকেরল চেহারা যে বদলায়নি, তা বুঝতে ভুল করেননি কবি। তাই শিলাদিত্য হালদারকে যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাওবাদী বলে দেগে দিয়েছিলেন, তখন লিখেছিলেন, 'এখনও তুমি প্রতিবাদ করো?
---মাওবাদী।
প্রশ্ন করার সাহস করেছো?
---মাওবাদী।' আবার পঞ্চায়েত ভোটের সময় লিখেছিলেন, 'যথার্থ এই বীরভূমি-/উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে/পেয়েছি শেষ তীরভূমি/দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/রাজ্যজুড়ে খড়গ হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।'
কিন্তু, প্রতিবাদী হওয়া সত্ত্বেও কবির মধ্যে ছিল এক পিতার মন। তাই তো তিনি বাবরের প্রার্থনা কবিতায় লিখেছেন, 'এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত—
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।....' কবির মেয়ে তখন অসুস্থ। তাঁর আরোগ্য কামনায় এই কবিতা লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু, কবিতাটি সার্বজনীন হয়ে ওঠে। তাঁর এই প্রার্থনা শুধু নিজের মেয়ের জন্য নয়, এ যেন ভারতবর্ষের যুবকদের জন্য। তিনি যেন পিতা হয়ে উঠেছিলেন এখানে। তাই তো সমালোচকরা শঙ্খ ঘোষকে বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক বলেছেন। সত্যিই তো অভিভাবককেই হারাল বাংলা সাহিত্য।'