কবি শঙ্খ ঘোষ – আত্ম আবিষ্কারের এক অনির্বাণ যাত্রা

'যুবক শঙ্খ ঘোষের মনেও কৈশোরকালের ফেলে আসা পূর্ব বাংলার গ্রামের সুপুরিবনের স্মৃতি জাগরুক ছিল। ছিন্নমূল মানুষের দগ্ধ হৃদয়ের বেদনার্ত পরিভাষা তিনি জেনেছিলেন' - প্রয়াত কবির স্মরণে কলম ধরলেন ড: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement
কবি শঙ্খ ঘোষ – আত্ম আবিষ্কারের এক অনির্বাণ যাত্রাখেলা হবে খেলা হবে,হুইলচেয়ার ঠেলা হবে
হাইলাইটস
  • আজই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ
  • বাংলা সাহিত্যের এই অভিভাবকের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সবাই
  • পঞ্চাশের দশকের কবি শঙ্খ ঘোষের জীবন দর্শন কী ছিল?

কবি শঙ্খ ঘোষ বাংলা কবিতার জগতে কবি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিগত শতকের সেই ভঙ্গুর কালবেলায় বাঙালী দুটি নির্মম ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলো ) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, (১৯৪৬ খ্রি)) দেশভাগ (১৯৪৭ খ্রি)কলকাতা বা তৎসংলগ্ন তরুণ সমাজ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষ্য ছিলেন তাঁদের তারুণ্যের মাঝখানে তাঁরা শুনেছিলেন, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল বলছে -- ‘এ আজাদী ঝুটা হ্যায়তাঁরা দেখেছিলেন লক্ষ লক্ষ উদ্‌বাস্তু মানুষের কাতর আবেদন ও অসহায় মুখচ্ছবি। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধুমাত্র ধর্মের কারণে ছিন্নমূল হয়ে এপার বাংলায় আশ্রয়লাভের জন্যে চলে এসেছে। এই স্রোত অব্যাহত ছিলো ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের পরেও। স্বাধীনতার পরের তিন বছরে আমাদের শিক্ষিত বাঙালীরাও স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলো তাঁরা ভেবেছিল  ‘মিত্র বাবুমশায়ে মত – ‘নতুন সমাজ চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবেগঠিত হবে এবং সকল পুরাতনী কুসংস্কার, বন্ধন, সংকীর্ণতা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে আর সমাজের, দেশেরখোলনলিচাবদলে যাবে যে কঙ্কালসার শতচ্ছিন্ন ভারতবর্ষকে ইংরেজরা রেখে গিয়েছিলো, সেখান থেকে পুনর্জাগরণের পথ আবিষ্কারের কল্পনা করেছিলো সকলেউচ্চবিত্ত নাগরিক থেকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ মানুষেরাও যেন এই স্বাধীনতার স্বাদ পায়, এই ছিলো সেই সময়ের শিক্ষিতদের স্বপ্ন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে বহু প্রতীক্ষিত ভারতের সংবিধানগৃহীত হয়গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের যাত্রা শুরু হয়। মানুষ মত প্রকাশের ও নির্বাচনের অধিকার পায়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে গণভোট গৃহীত হয়। শুরু হয় উন্নয়ন ও দেশ গঠনের জন্যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা।

Advertisement

সময়টা বড্ড অস্থির ছিলো তখনওকিছুদিনের মধ্যেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন-পদ্ধতির মাধ্যমে আমরাই তৈরি করেছিলাম আমাদের সরকার। কেন্দ্রে তখন জওহরলাল নেহরুর (১৮৮৯ খ্রি ১৯৬৪ খ্রি) নেতৃত্বে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন্ত্রিসভা। আমাদের বিভঙ্গ বাংলায় প্রথমে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (১৮৯১ খ্রি ১৯৮৩ খ্রি), পরে সেই প্রবাদ-প্রতীম সর্বত্যাগী ব্যক্তিত্ব বিধানচন্দ্র রায়ের (১৮৮২ খ্রি ১৯৬২ খ্রি) নেতৃত্বে রাজ্য-সরকার১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলার কৃষকের লাঙল যার জমি তার’ -- এই শ্লোগান সঙ্গে নিয়ে তেভাগাআন্দোলন আছড়ে পড়লো বাংলায়। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে এই কলকাতার রাস্তায় ভুখা মিছিলের ওপর গুলি চালিয়েছিলো  পুলিশ। প্রায় আশিজন ভুখা মানুষ সেই গুলিতে নিহত হয়। গ্রেপ্তার হয় প্রায় সতেরো হাজার কৃষক। এই দশকেই ঘটেছিলো প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। কলকাতার শিক্ষিত সমাজ এই সকল ঘটনায় আলোড়িত হবে এটাই স্বাভাবিক

Advertisement

Shankha Ghosh

 

Advertisement

তরুণ শঙ্খ ঘোষ এই দুর্মর, দুর্বিসহ দিন গুলির প্রত্যক্ষ অংশীদার ছিলেন তাঁর মনেও কৈশোরকালের ফেলে আসা পূর্ব বাংলার গ্রামের সুপুরিবনের স্মৃতি জাগরুক ছিল ছিন্নমূল মানুষের দগ্ধ হৃদয়ের বেদনার্ত পরিভাষা তিনি জেনেছিলেন কিন্তু পঞ্চাশের দশকে যাঁরা কবিতা চর্চা করতে শুরু করেছিলেন তাঁরা প্রায় কেউই সেইসময়ের এইসব গণ-আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই সমসময়ের যন্ত্রণাবিদ্ধ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিলেন শঙ্খ ঘোষ যেন সেই ব্যথা বেদনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানায়ত, স্থিতধী, সৌম্য রূপ সৌন্দর্যের রেখা অঙ্কন করেছেন কবিতায় শুধু কবিতায় নয় রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কিত বই গুলিতেও তিনি এক অবিনশ্বর সুন্দরের অন্বেষণ করেছেন যুবক বয়সেবহুরূপীঅভিনীত রবীন্দ্র নাটক দেখেছেন আবার তারই পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সেই সব চিরকালীন নাটকগুলির আলোচনায় এক চিরন্তনের রূপ প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেনকালের মাত্রা রবীন্দ্র নাটকবই এর সেই সব ঋদ্ধ আলোচনায় রাজানাটকের রাজা, ‘বিসর্জনে জয়সিংহ, ‘রক্তকরবী নন্দিনী কিংবা মুক্তধারানাটকের অভিজিতের মধ্যে নিজের চিন্তা, চেতনা মননের অনুগামী ঋদ্ধিকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন আমির আবরণদামিনীর গানদুটি বই এর মধ্যেও আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের অপরূপ, কালজয়ী এবং সর্বাতিশায়ী মুর্ছনার মাঝখানে নিজের আমিকেই যেন খুঁজে চলেছেন সময় থেকে সময়ান্তরে তাঁর মনে হয়েছিলো বাংলা সাহিত্যের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্র নাথের কবিতার শ্রেষ্ঠ পর্যায় হলো তাঁর শেষ জীবনে রচিত চারটি কাব্যগ্রন্থ এই পর্যায়ের কবিতাগুলি যেন মেদবর্জিত, ঋজু, স্বল্পবাক এবং দার্শনিকতা চেতনার অভূতপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত রবীন্দ্র অনুরাগী শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্র নাথের শেষ পর্যায়ের সেই চারটি কাব্যের আলোচনা করেছেন তাঁরনির্মাণ আর সৃষ্টিনামক গ্রন্থে আলোচনা না বলে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের কবিতাগুলির মধ্যে নিজেরই এক সুষম চেতনাকে খুঁজতে চেয়েছেন

Advertisement

তাঁর বিভিন্ন সমৃদ্ধ আলোচনাগুলি যেন তাঁর রচিত কবিতার সহোদরা কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন – ‘একদিন কবিতার কাছে দাবি করা হয়েছে যে, সে বদলে দেবে সভ্যতার মুখশ্রী। কবির দায়িত্ব প্রায় সন্তের, নেতারএই প্রবন্ধেই আমির সংকীর্ণ ও বৃহত্তর পরিসরকে তাঁর সমকালীন ও পূর্ববর্তী বিভিন্ন কবিদের উচ্চারণ থেকে নিজেই বুঝে নিতে চেয়েছেন সম্যকভাবে। কখনও সেই আমিহয়ে উঠতে চেয়েছে নেহাতই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় কীর্ণ এক নির্মোহ ব্যক্তিসত্তাকখন সে বুঝে নিতে চেয়েছে পরিপার্শ্ব-সমেত সমগ্র সামাজিক আমিত্বকে।  তাঁর কবিতার মধ্যেও তিনি সেইআমি পরিসরকে খুঁজেছেন আমৃত্যু উপনিষদের সেই অমোঘ বাণী -- ‘আত্মনাং বিদ্ধি’- যেন শঙ্খ ঘোষের কবিতার মূল ভাষ্য

Advertisement

তিনি লিখছেন --

Advertisement

আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বংসহা

Advertisement

                            লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে

Advertisement

গোপন রক্ত যা কিছুটুকু আছে আমার শরীরে, তার

                              সবটুকুতে শস্য যেন ফলে।

এ হলো নিজের সঙ্গে নিজের সত্তার লড়াই। এ এক নতুন আত্মবীক্ষণ। নতুন এক বিষাদের আবহ এখানে কবিকে মাধবী-গর্ভে নিমজ্জিত হতে প্ররোচনা দিয়েছে। রয়েছে নতুন এক আত্ম জ্ঞানের পরিসর

অন্য আরেকটি কবিতায় --

                   আমিই আমার নিজের হাতে রঙীন করে দিয়েছিলাম

Advertisement

                   ছলছলানো মুখোশমালা, সে কথা তুই ভালোই জানিস-

                   তবু কি তোর ইচ্ছা করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে

                   সবার হাতে ঘুরতে ঘুরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন।

এখানেও দেখা যায় নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন এও সময়ের চাপে বিধ্বস্ত এক মধ্যবিত্ত কবির আত্মবিলাপ যে সময় শুধুই বিধ্বস্ত করে ব্যক্তিকে, ব্যক্তির নিজস্ব সত্তাকে।

আরেকটি কবিতায় আমরা দেখি--

                   জড়াও রেশমি দড়ি, জড়ি ছড়াও সুন্দরী

                   দিনে দিনে চাও পদতলে

                   ভিখারী বানাও,

                   কিন্তু মনে মনে জাননি কখনো

                   তুমি তো তেমন গৌরী নও।

Tapas Banerjee
কবি শঙ্খ ঘোষ – আত্ম আবিষ্কারের এক অনির্বাণ যাত্রা ; লিখেছেন ড: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত প্রায় সকল কবির মত শঙ্খ ঘোষের প্রতিভা আসলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে বহন করেকেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন যে– ‘পূর্বগামীদের আধুনিকতার বদলে এরা নতুন কোনো আধুনিকতা আনেননি। তাদের ভাষা চেতনার বদলে কোনো নতুন চেতনার জন্ম দেয়নিঅথচ এরাই নিজেদেরকে বিভিন্নভাবে নতুন’, ‘অভিনব’, বিদ্রোহী’, ‘কালাপাহাড়ীবলে ঘোষণা করতে চেয়েছেন। কিন্তু নির্মম সত্য হলো রবীন্দ্রোত্তর যে সকল কবিদের কাছে এরা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন বলে এরা দাবী করেন, সেই জীবনানন্দের উত্তরকালের সময় ও ইতিহাসচেতনা, সুধীন্দ্রনাথের মনন ও দার্শনিক চেতনা, অমিয় চক্রবর্তীর বিশ্ববীক্ষা ও আন্তর্জাতিকতার বোধ, বিষ্ণু দের পুরাণ ও আধুনিকতার মেলবন্ধনের স্থিতধী মেধাকে এরা ধৈর্যসহ আত্মস্থ করার গরজও দেখাননি। কিন্তু এরা নিজেদের সত্তার সতত জাগরুক, সতত জায়মান অনুভবের মধ্যে নিজেকেই আবিষ্কার করতে চেয়েছেন  

Advertisement

সমসময়ের কবিতা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন -- যখন ধিকিধিকি সন্দেহের আগুনে শহর জ্বলে যায় তখন এই কবি দুঃখ আস্বাদের অন্য অর্থ খুঁজে পান, শুধু সেজন্য এমন মনে করা ভুল যে পরিপার্শ্বকে উপেক্ষা করেন তিনি, বরং তাঁরই কবিতার চিত্রমালায় সবচেয়ে প্রকীর্ণ দেখতে পাই সর্বাবয়ব বাংলাদেশএই কথা তাঁর রচিত কবিতা সম্বন্ধেও কাটে তিনিও বুঝেছিলেন এই বাংলাদেশ আসলে সমসময়ে ভিন্ন ঘটনা-পরম্পরায় আলোড়িত, উৎক্ষিপ্ত, বিপর্যস্, হতাশ বাংলাদেশ নয়। পরন্তু তা মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক উদ্ভাসে পাহাড়, পর্বত, মালভূমি, টিলা, খোয়াই, জঙ্গল-সমৃদ্ধ চিরকালীন সুস্থির বাংলাদেশ মাত্র। কবি শঙ্খ ঘোষ আমৃত্যু সেই স্বদেশের স্বচেতনার অন্বেষণ করেছেন

Advertisement

(লেখক পরিচিতি - নাম: তাপস বন্দ্য়োপাধ্যায়। জন্ম - গত শতকের ষাটের দশকে। বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ডে। লেখাপড়া কাটোয়া কলেজ। পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা অধ্যাপনা। গবেষণা উত্তর আধুনিক কবিতা, বাঙালীর নৃতত্ত্ব ও আঞ্চলিক ইতিহাস৷ প্রকাশিত বই - শক্তির কবিতা, কবিতার শক্তি।)

POST A COMMENT
Advertisement