গত ১৩ মে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পাওয়ার পর থেকে, মানুষের মুখে মুখে ফিরছে অনীক দত্ত (Anik Dutta) পরিচালিত ও জিতু কমল (Jeetu Kamal) অভিনীত 'অপরাজিত' (Aparajito)-র নাম। রাজ্য তো বটেই, এমনকি দেশের একাধিক প্রেক্ষাগৃহে এখনও 'হাউজফুল' যাচ্ছে শো। সম্প্রতি বিদেশেও মুক্তি পেয়েছে এই ছবি, যা যথেষ্ট প্রশংসিত। সত্যিই অপরাজিত, ছবির গোটা টিম। আর তার মধ্যে যে মানুষটিও প্রশংসার দাবি রাখেন, তিনি হলেন অপরাজিত রায়ের সহযোদ্ধা সুবীর মিত্র।
বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রের (Subrata Mitra) ছায়ায় তৈরি এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবাশীষ রায় (Debasish Roy)। 'ক্রাউড আর্টিস্ট' (Crowd Artist) থেকে সুবীর মিত্র হয়ে ওঠার তাঁর লড়াইটা একেবারেই সহজ ছিল না। ২৮ মে অভিনেতার জন্মদিন। আজতক বাংলার সঙ্গে নিজের জার্নি শেয়ার করলেন অভিনেতা।
আজতক বাংলা: কেমন আছেন? চারিদিকে সব কিছু তো 'অপরাজিত-ময়'!
দেবাশীষ: হ্যাঁ, শেষমেশ আমরা অপরাজিত হতে পেরেছি। এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে যেন ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখছি।অনীক দা এসে জাগিয়ে বলবেন না না এটা শুধু একটা স্বপ্ন, আমাদের এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এটা স্বপ্ন না, 'অপরাজিত' সফলভাবে চলছে প্রেক্ষাগৃহে। আশা করি আরও অনেকদিন চলবে। তবে এর পরে আরও ভাল কাজ করতে ইচ্ছে করছে।
প্রশ্ন: দর্শকদের প্রত্যাশা যেমন বাড়ছে, দায়িত্বও তো বেড়ে গেল...
দেবাশীষ: অবশ্যই দায়িত্ব বেড়ে গেল। 'অপরাজিত'-র পর, আরও বেশি করে শিখতে ইচ্ছে করছে। এরপর যখনই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবো, আমার মনে হবে এই ছবির থেকেও আরও ভাল কী করে করা যাবে। নয়তো দর্শকেরা তুলনা করতে শুরু করবেন।
প্রশ্ন: সুব্রত মিত্রের ছায়ায় তৈরি চরিত্রে অভিনয় করে কতটা প্রাপ্তি হল?
দেবাশীষ: আমার মনে আছে যেদিন অনীক দা আমায় সকালবেলা ফোন করে বললেন যে, তোমায় সুবীর মিত্র চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। আমি সেই মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে তখনই অনীক দা আমায় থামিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: তার মানে রিলের অপরাজিত রায়ের ফোনের সঙ্গে রিয়েল লাইফেও অনেকটা মিল আছে?
দেবাশীষ: হ্যাঁ, ওরকই একটা অনুভূতি। ছবিতে যখন বলা হচ্ছে, 'তুমিই এই ছবির চিত্রগ্রাহক...', আমি বলছি 'ঠাট্টা করছেন?'...আমিও অনীক দা-কে ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিলাম। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। তখন তিনি আমায় বললেন, 'তোমার এই উত্তেজনা চলবে না। কারণ ছবিতে সুবীর মিত্র সিনেমা নিয়ে খুব প্যাশনেট এবং ওর কাছে ক্যামেরাটাই সব কিছু। খুব কম কথা বলে, অল্প হাসে, গম্ভীর একটা চরিত্র। তাই তুমি একটু স্টাডি করো সুব্রত মিত্রকে নিয়ে।'
প্রশ্ন: এরপর কি হোমওয়ার্ক শুরু হল?
দেবাশীষ: হ্যাঁ, আমি যতটা পেড়েছি চেষ্টা করেছি। খুব জনপ্রিয় একটা ভিডিও আছে, যেখানে সুব্রত মিত্র- সত্যজিৎ রায়রা রেকি করতে যাচ্ছেন। আমি বারবার দেখেছি সেটা। ওখানে দেখি যে উনি বারবার চশমা খুলছেন এবং চোখ পিটপিট করছেন। সেটা কেন আমি জানার চেষ্টা করি। পরবর্তীকালে জানতে পারি, সেই সময় ওঁর চোখের সমস্যা ছিল এবং চশমা ছাড়া থাকতে পারতেন না। ক্যামেরার ভিউ পয়েন্টারে চোখ রাখার পর কাজ হয়ে গেলেই, চশমা পরে নিতেন তাড়াতাড়ি। আমি ছবিতেও আমার চরিত্রের মধ্যে এটা রাখার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আমি খুব তাড়াতাড়ি কথা বলি, কিন্তু চরিত্রে খুব ধীরে ধীরে- মেপে মেপে কথা বলতে হয়েছে। আর এই কৃতিত্বটা সম্পূর্ণ অনীকদার। উনি বারবার আমার ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন। অনেক রাত অবধিও বহু ইংরাজি উচ্চারণ প্র্যাকটিস করেছি হোয়াটস অ্যাপের কথোপকথনের মাধ্যমে।
প্রশ্ন: 'অপরাজিত'-তে ব্রেক পেলেন কীভাবে?
দেবাশীষ: লকডাউনে আমি বুঝতে পেরেছিলাম হয় লড়তে হবে নয় এই কাজ ছাড়তে হবে। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, যাই হয়ে যাক লড়াই করা ছাড়বো না। আমি একের পর এক ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করি। এরকমই একটা ভিডিও অনীকদা নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেন এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয় আমার সুবীর মিত্র হয়ে ওঠার জার্নি।
প্রশ্ন: তার মানে সোশ্যাল মিডিয়াকে চাইলে ভাল কাজেও ব্যবহার করা যায়?
দেবাশীষ: একদমই তাই! আমি একবার একটি ভিডিও বানিয়ে লিখেছিলাম যে, আমায় তো দেখতে খারাপ তাই সেলফি তুলে বা রিল বানিয়ে পোস্ট করতে পারি না। যখন সারা পৃথিবী 'কাকলি ফার্নিচার' বা ডালগোনা কফি বানানো শেয়ার করছিল, আমি যেটা করতে পারি সেটা দিয়েই সকলকে মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করেছি। বলার মতো কথা হল, সেসময় আমার ওই অভিনয়ের ভিডিওগুলির মাধ্যমেই বহু প্রথম সারির পরিচালকদের নজরে এসেছি।
প্রশ্ন: চরিত্রটা থেকে কী পেলেন তাহলে?
দেবাশীষ: 'অপরাজিত' আমার কাছে একটা শিক্ষা। এত কিছু শিখেছি যে, এটা আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। মানুষ ভাল বলছে, এত গুণী মানুষদের থেকে কাজের প্রশংসা পাচ্ছি, সত্যিই ভাল লাগছে।
প্রশ্ন: আপনি তো থিয়েটারও করতেন?
দেবাশীষ: হ্যাঁ। তবে এখন সেভাবে থিয়েটারের কাজ চলছে না। ভবিষ্যতে একটা ভাল প্রোডাকশন করার খুব ইচ্ছে আছে। আসলে আমি থিয়েটারে ফিরতে খুব ইচ্ছুক। আমার অভিনয় শিক্ষার গুরু দেবাদিত্য মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও আমি দেবশংকর হালদার ও গৌতম হালদার দু'জনেরই ছাত্র। ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় কাজ করেছি দীর্ঘদিন।
প্রশ্ন: এর আগে বড় পর্দায় কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
দেবাশীষ: একজন জুনিয়র আর্টিস্ট থেকে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি আমি। 'পাগলু', 'কাহানি' সহ আরও বহু ছবিতে আমি জুনিয়র আর্টিস্টের কাজ করেছি। একটা সময় ছিল যখন, একশো -পাঁচশো জনের ভিড়ে দাঁড়াতাম শুধু এক প্যাকেট বিরিয়ানির জন্য। 'বাচ্চা শ্বশুর'-এ ক্রাউড অভিনেতা ছিলাম। সেখান থেকে পাভেল দা ওই ছবিতে অন্য একটা ছোট চরিত্রে আমায় নিয়ে আসে। এরপর 'দ্বিতীয় পুরুষ', 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি', 'সুইৎজারল্যান্ড'-র মতো ছবিতে আমার এই জার্নিটা শুরু। তবে আমি যে কটা জায়গায় ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেছি, তা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। জিৎ দা, আবির দা সকলে ট্যুইট করেছিলেন আমার কাজ দেখে।
প্রশ্ন: আর ছোট পর্দার অভিজ্ঞতা?
দেবাশীষ: 'গ্যাংস্টার গঙ্গা' ধারাবাহিক দিয়েই আমার অভিনয় শুরু। এরপরই বড় পর্দায় কাজ শুরু হয়। ছোট পর্দায় কাজ পাওয়ার জন্য বহু জায়গায় ঘুরেছি, তাও একটা কাজও পাইনি সেসময়। এরপর টেলিভিশনে কাজ করা হয়ে ওঠেনি আর। তবে বিরসা দাশগুপ্তের 'মাফিয়া' নামের একটি হিন্দি প্রোজেক্টে কাজ করি। আমার এই কয়েকদিনের কেরিয়ারে আমি যে পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তাঁদের থেকে শিখে নিজেকে অনেকটা ঘষেমেজে নিতে পেরেছি।