বাংলাতেই বাংলা ছবি দেখানো যায় না। বলিউডের দিকে এই অভিযোগ বহুদিন ধরে তুলছেন টলিউডের শিল্পী- পরিচালক- নির্মাতারা। বারবার ক্ষোভ উগড়ে দিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। বৈষম্যের শিকার বাংলা ছবি। কয়েক বছর ধরেই বাংলা ছবি নিজের রাজ্যেই কদর পায় না। বলিউডের বিগ বাজেট ছবির দাপটে প্রাইম টাইমে শো দেওয়া হয় না বাংলা ছবিকে। ফলে মুক্তির পর দ্বিতীয় সপ্তাহ পৌঁছানোর আগেই প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় বহু ছবি।
একই সময় বাংলা ছবি ও হিন্দি ছবি মুক্তি পেলে, এ রাজ্যে টলিউডকেই পিছনে ফেলে দেয় বলিউড। প্রাইম টাইমে শো দেওয়া হয় না বাংলা ছবিকে। এবার এই সমস্যার সমাধানের আসায় একজোট হলেন টলিউড তারকারা। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, শ্রীকান্ত মোহতা, নিসপাল সিং রানে, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়রা মিলিতভাবে সরাসরি চিঠি পাঠান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। পরে একই অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এরপর, আজ (৭ অগাস্ট) নন্দনে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, বৈঠকের ডাক দেন প্রসেনজিৎদের। এদিন গোটা বিষয় নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অরূপ বিশ্বাস জানান, "প্রায় আড়াই লক্ষের বেশি মানুষকে নিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। চলতে চলতেই সমস্যা হয়, আবার মিটে যায়। আমাদের সেভাবে কোনও সমস্যা ছিল না। কাজ করতে গেলে এরকম অনেক মতবিরোধ, মত পার্থক্য থাকে। আবার আমরা যেই সবাই মিলে একসঙ্গে বসলাম, সব মিটে গেল। আর কোনও অসুবিধা নেই। সিদ্ধান্ত আমরা নিজেদের মতো করে নিয়েছি।"
তিনি যোগ করেন, "আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে বসেছিলাম, আমরা সবাই চাই, যেভাবে বাংলা ভাষাকে গলা টিপে মারার চেষ্টা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী ভাষা আন্দোলন চালু করেছেন। ওরা বলছে, বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা নাকি কোনও ভাষাই নয়। আরও বেশি করে যাতে বাংলা ভাষাতে ছবি তৈরি হয়, বাংলা ছবি যাতে দর্শক দেখতে পান, সেটার জন্য এই আলোচনা, এবং এটা ফলপ্রসূ হয়েছে। এটুকু বলতে পারি, বাংলায় বাংলা সিনেমাই প্রাধান্য পাবে।"
দেব বলেন, "সমস্ত ডিস্ট্রিবিউটর ও এক্সিবিটর অর্থাৎ সিনেমা হলের মালিকদের ধন্যবাদ জানাই। হিন্দি ছবি এলেই বলে বাংলা ছবি চালাতে দেব না। আমাদের মনে হয় এটা বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ এই নিয়ম ভারতবর্ষের কোথাও নেই। দক্ষিণের ইন্ডাস্ট্রি হোক পঞ্জাব, এই নিয়ম কোথাও নেই। আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা আমি ফেস করেছি 'টনিক' মুক্তির সময় '৮৩' এসেছিল। আজ 'ধূমকেতু'-র সময় আবার একই জিনিস হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে যৌথভাবে ঠিক করলাম এই 'নো শো শেয়ারিং' শব্দটাই বন্ধ হবে বাংলায়। বাংলায় বাংলা ছবি চালাতে হবে। যেই ছবিই আসুক না কেন। তাদেরতাও চলুক, আমাদেরতাও চলুক। আমরা যেন জায়গাটা পাই নিজেদের প্রমাণ করার জন্য।"
অভিনেতা- প্রযোজক জানালেন, "আমরা সবাই এক মত। আজ খুব সুন্দর একটা আলোচনা হয়েছে। এখানে প্রীতমদা ('ওয়ার ২' ছবির ডিস্ট্রিবিউটর) শতদীপ ('ধূমকেতু' ছবির ডিস্ট্রিবিউর) ওঁরাও ছিল। সবাই সুযোগ পাবে। এবার ছবিটাকেও ভাল পারফর্ম করতে হবে। আমার শেষ ছবি খাদান ব্লকবাস্টার হওয়ার পরও আমায় এই লড়াইটা করতে হচ্ছে। তাহলে ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টররা কী করবেন। এই লড়াইটা ধূমকেতুর না, এটা বাংলা ইন্ডাস্ট্রির লড়াই।"
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "অনেক সময়ই আলোচনা হয় ছবি দেখার জায়গা বা যথেষ্ট হল পাই না। বাংলা ভাষার যে ছবি তার মর্যাদা যদি বাংলাতেই না থাকে, তাহলে কোথায় থাকবে। সবচেয়ে আনন্দের কথা, আজ সকলে মিলে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে, এমন কোনও থিয়েটর থাকবে না, যারা বাংলা ছবি চালাবে না। প্রাইম টাইমেই সারা বছর ধরে চালাবেন।"
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর কথায়, "আজকে যে সিদ্ধান্তটা হয়েছে, সেটা বোধ হয় অনেকদিন আগেই হওয়া উচিত ছিল। আমি আগেও অনেকবার এটা নিয়ে কথা বলেছি। চেয়েছি নিজেদের মধ্যে সমস্যাটা মেটাতে। কিন্তু সেটা কখনও সম্ভব হয়নি। আমার বহু এজন্যে সাফার করেছে। তবে এখন এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা আমাদের কাছে খুবই আনন্দজনক। একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে, বাংলাকে একটা বড় জায়গা দেওয়া হবে। হলগুলোতে বাংলা ছবিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে এবং প্রাইম টাইম দেওয়া হবে। এটা বাস্তবায়িত হলে আরও বেশি আনন্দিত হব। নয়তো বাংলা ছবিকে সত্যিই বাঁচানো যাবে না।
প্রসঙ্গত, আগামী ১৪ অগাস্ট মুক্তি পাবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি 'ধূমকেতু'। যা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে। অপরদিকে, ১৫ অগাস্ট মুক্তি পাচ্ছে হৃত্বিক রোশন ও কিয়ারা আদবাণীর 'ওয়ার ২'। এই ছবি ডিস্ট্রিবিউটাররা শর্ত রেখেছিলেন যে, তারা এ রাজ্যে কোনও বাংলা ছবির সঙ্গে শো ভাগ করে নেবেন না। এরপরই গোটা বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে একত্রে চিঠি লেখেন টলিউডের অভিনেতা- পরিচালক- প্রযোজকরা।