scorecardresearch
 

প্রবাদপ্রতিম তুলসি চক্রবর্তী উপেক্ষিতই থেকে গেলেন! আজ তাঁর জন্মদিনে বিশেষ নিবেদন

কত কথা সর্ব ক্ষণ বলে যেত তাঁর চোখ। বড় বড় বিষ্ময়ভরা ধারালো চোখের তারা নিখুঁত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলত। একেবারে মাপ করে, কোথাও কম-বেশি হওয়ার জো নেই। এ হেন অভিনেতাকে চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে জীবন কাটিয়ে যেতে হয়েছে। শেষ বয়সে দেখতে হয়েছে অন্নাভাব। কেন? ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

Advertisement
তুলসি চক্রবর্তী তুলসি চক্রবর্তী
হাইলাইটস
  • ১৮৯৯ সালে জ্ন্ম তুলসিবাবুর। ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম সিনেমা পুনর্জন্ম মুক্তি পায়।
  • সিনেমায় অভিনয় করার প্রথম ৭-৮ বছর বাদ দিলে তার পরের প্রত্যেক বছর নিয়ম করে তুলসি বাবুর ৩-৪টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
  • ১৯৫৪ সালে তুলসি বাবুর ১১টি সিনেমা মুক্তি পায় এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ১৩টি। মাত্র ২ বছরে ২৪ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি!
  • চিরকাল ট্রামে-বাসে যাতায়াত করে স্টুডিও পৌঁছতেন। সেই হাওড়া থেকে টালিগঞ্জ। গরমকালে পরনের জামা বা ফতুয়া কাঁধে ফেলে দিব্য ট্রামের জানালার ধারে বসে সফর করেছেন শহর কলকাতায়।

বাংলা সিনেমার ইতিহাস লিখতে গেলে যদি ৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম বাছতে হয়, তুলসি চক্রবর্তী অনায়াসে সে তালিকায় জায়গা করে নেবেন। বাংলায় একটা কথা আছে, চোখে-মুখে কথা বলা। তুলসি চক্রবর্তীর মুখ দেখেই বোধ করি সে প্রবাদ তৈরি হয়েছিল। সত্যিই তো, তিনি অভিনয় করতেন কখন? সবটাই তো ন্যাচেরাল, প্রাকৃতিক। কোনও খাদ নেই। উচ্চকিত স্বরে গলা কাঁপিয়ে ডায়ালগ নেই। ভাঁড়ামো নেই, ন্যাকামো নেই, ছদ্ম গাম্ভীর্য নেই, তবে আছেটা কী? ওই, চোখ দু'টি। কত কথা সর্ব ক্ষণ বলে যেত তাঁর চোখ। বড় বড় বিষ্ময়ভরা ধারালো চোখের তারা নিখুঁত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলত। একেবারে মাপ করে, কোথাও কম-বেশি হওয়ার জো নেই। এ হেন অভিনেতাকে চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে জীবন কাটিয়ে যেতে হয়েছে। শেষ বয়সে দেখতে হয়েছে অন্নাভাব। কেন? ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
 

একের পর এক সিনেমা
১৮৯৯ সালে জ্ন্ম তুলসিবাবুর। ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম সিনেমা পুনর্জন্ম মুক্তি পায়। অর্থাৎ ৩৩ বছর বয়সে তিনি বড় পর্দায় মুখ দেখান। তার আগে নাটক এবং যাত্রায় খুব নাম করেন। তার দৌলতেই সিনেমায় ডাক আসে। সিনেমায় অভিনয় করার প্রথম ৭-৮ বছর বাদ দিলে তার পরের প্রত্যেক বছর নিয়ম করে তুলসি বাবুর ৩-৪টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ১৯৫৪ সালে তুলসি বাবুর ১১টি সিনেমা মুক্তি পায় এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ১৩টি। মাত্র ২ বছরে ২৪ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি! তার পরেও এমন অবস্থা কোনও অভিনেতার হতে পারে তা কল্পনাতীত। চিরকাল ট্রামে-বাসে যাতায়াত করে স্টুডিও পৌঁছতেন। সেই হাওড়া থেকে টালিগঞ্জ। গরমকালে পরনের জামা বা ফতুয়া কাঁধে ফেলে দিব্য ট্রামের জানালার ধারে বসে সফর করেছেন শহর কলকাতায়। একবার কল্পনা করুন, আজ তাঁর মতো একজন অভিনেতা কেমন জীবন কাটাতে পারতেন বা সাধারণত কেমন জীবন কাটিয়ে থাকেন।

Advertisement

 

'না' বলতে না পারা
কখনও কখনও না বলাটা অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্তত তুলসি বাবু যদি কথাটি বুঝতেন, তবে তাঁকে মাত্র ৬২-তে এ ভাবে চলে যেতে হত না। আরও বেশ কিছু অমর অভিনয় কীর্তি রেখে যেতে পারতেন তিনি। তিনি কাউকে কোনও দিন ফেরাননি। যে যা চরিত্র নিয়ে তাঁর কাছে যেতেন তিনি সম্মতি দিতেন এবং নিয়ম করে শুটিংয়ে যেতেন। কখনও পারিশ্রমিকের কথা মুখ ফুটে বলতেন না। চাইতেনও না। অনেকেই তাঁর যোগ্য দূরস্থান, তিনি যতটা টাকা নিতেন সেটা না দিয়েই কাজ করিয়ে নিতেন। এমন ঝুরি ঝুরি অভিযোগ রয়েছে। জীবনে কখনও পারিশ্রমিক বাড়াননি। আসলে ছোট থেকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়ার সুবাদে হয়তো একটা ভয় তাঁর মধ্যে কাজ করত। তিনি ভাবতেন, যদি পারিশ্রমিক বাড়ালে আর ডাক না আসে। জাত অভিনেতা ছিলেন, তাই অভিনয় করেই সুখ পেতেন। পরবর্তী কালে কী হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিলেন না। বা বলা ভালো একরকম ইনসিকিওরিটি নিয়েই সে ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
 

 

সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন
ফ্রম পথের পাঁচালি টু পরশ পাথর। সত্যজিৎ রায় এই দু'টি সিনেমায়, আরও স্পষ্ট করে বললে, পরশ পাথর সিনেমাটি তাঁকে মূল চরিত্রে কাস্ট না করতেন তবে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করত না ইতিহাস। সত্যজিৎ রায় তাঁকে অন্তত একুটু সাহায্য করে গিয়েছেন। না এটাই শেষ নয়। পরশপাথর সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে তিনি তুলসি বাবুর বাড়িতে যান। পারিশ্রমিকের অঙ্ক শুনে সত্যিজিতের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন তুলসি। যা দেখে সত্যিজিৎ খানিকটা বিব্রতই হয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, তুলসি চক্রবর্তীর যা পারিশ্রমিক হওয়া উচিত তা তিনি দিতে পারছেন না। তাও এই পারিশ্রমিকের কথা শুনে ভদ্রলোকের চোখে জল! শুটিং চলাকালীন বাড়ি থেকে স্টুডিও যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু খানিকটা ভয়েই সে প্রস্তাবে সায় দেননি তুলসি। তিনি সত্যজিৎ রায়কে বলেওছিলেন, 'না রে বাবা, আমার ট্রাই ভালো। গাড়িতে চেপে স্টুডিও এলে প্রযোজকরা ভাববে তুলসি বুঝি রেট বাড়িয়ে দিল। ওরা আর কাজে ডাকবে না আমায়।' হিরোর রোল করেও এর কম টাকায় অভিনয় করার জন্য সত্যজিৎ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেও এত কম টাকায় রাজি হলেন কেন?' জবাবে তুলসি সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। কোথাও যেন একটা ভয় তাঁর মনে চেপে বসেছিল। যদি কাজ না আসে! আসলে পরশপাথররা নিজের মূল্য বোঝে না। যারা তাকে কুড়িয়ে পায় তাদের ভাগ্য ফিরে যায়। তুলসি বাবু তেমনই পরশপাথর ছিলেন।
 

 

অস্কার পাওয়া হল না
সত্যজিৎ রায় বহুবার একথা উল্লেখ করেছেন, যে তুলসি চক্রবর্তীর মাপের অভিনেতা যদি আমেরিকায় জন্মাতেন তবে অস্কার তাঁর ঝুলিতে শোভা পেত। অস্কার না হোক, বেঁচে থাকাকালীন কোনও উল্লেখযোগ্য পুরস্কার জোটেনি তাঁর কপালে। অনেকে বলবেন, সে সময় তাঁর অভিনয় দক্ষতা অনেকে বুঝতে পারেননি। হবে হয়তো, তবে যদি না-ই বুঝতেন এত ছবিতে কাস্ট করলেন কেন? পরবর্তী প্রজন্মের যাঁরা নামী শিল্পী, তাঁরা তো তুলসিবাবুর সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। তার পরেও একটা জাতীয় স্তরের পুরস্কার, পদ্ম সম্মান তাঁকে দেওয়া যেত না? ইতিহাস তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলেও যাঁরা পুরস্কার দিয়ে থাকেন, তাঁরা হয়তো এ সবের থেকে দূরেই থাকেন। তুলসি চক্রবর্তীকে কোন পুরস্কার দিলে তাঁকে সঠিক সম্মান দেওয়া হবে সেটা জানা নেই, তবে তাঁর নামে যদি কোনও পুরস্কার শুরু করা যায় তবে যে কোনও শিল্পী তা পেলে গর্ববোধ করবেন, নিঃসন্দেহে বলা যায়।
 

Advertisement

 

স্বামীর মেডেল বিক্রি করতে বাধ্য হন ঊষারানী
অস্কার, পদ্ম পুরস্কার বা জাতীয় পুরস্কারের কথা বলা হচ্ছে বটে, তবে বাস্তব এতটা কোমল নয়। বহুবার অভিনয় দক্ষতার জোরে অনেক মেডেল জিতেছিলেন তুলসি চক্রবর্তী। অভাবের তাড়নায় সে সমস্ত বিক্রি করতে হয়েছে তাঁর স্ত্রী ঊষা দেবীকে। দুমুঠো ভাতের জন্য দুয়ারে ধুয়ারে ভিক্ষে করতে হয়েছে তাঁকে। এমন প্রতিভার এত চরম বঞ্চনার নজির খুব কমই রয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন মনে পড়ে যায়, 'কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি।' ঊষাদেবী একথা বললে হয়তো কেউ লজ্জায় তাঁর দিকে তাকাতে পারতেন না। এ ক্ষেত্রে যদি একটি নাম করতে হয় তবে সেটি মিঠুন চক্রবর্তী। আর আর্টিস্ট ফোরাম খানিকটা আর্থিক সাহায্য করেছিল। এ ছাড়া নিঃসন্তান বিধবা মহিলার দিকে কেউ ফিরে তাকাননি।
 

এর চেয়ে আক্ষেপের আর কী হতে পারে। তুলসি নিজে পরশপাথর ছিলেন। বহু সিনেমা তাঁর অভিনয়ের ছোঁয়ায় সোনা ফলিয়েছে। কিন্তু সেই স্বর্ণ-পরশ তিনি নিজের স্ত্রীর জন্য রেখে যেতে পারেননি। চুপি চুপি একা চলে গিয়েছেন।

Advertisement