'গুমনামী'-র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (Prosenjit Chatterjee) -র নেতাজি লুক থেকে শুরু করে, 'এক যে ছিল রাজা'-র যিশু সেনগুপ্ত (Jisshu Sengupta), 'অপরাজিত'-র সত্যজিৎ রায় রূপে জিতু কমল (Jeetu Kamal) হোক কিংবা 'মহানন্দা'-র গার্গী রায়চৌধুরীর (Gargee RoyChowdhury), ছবিতে প্রথম লুক দেখেই অনেকে চমকেছেন। আর এই চমক যার রূপটানে সম্ভব হয়েছে, তিনি হলেন টলিপাড়ার এই মুহূর্তের সবচেয়ে চাহিদা সম্পন্ন মেকআপ আর্টিস্ট (Makeup Artist) সোমনাথ কুণ্ডু (Somnath Kundu)। বলা যায়, বাংলা ছবিতে প্রস্থেটিক মেকআপের (Prosthetic Makeup) ব্যবহার মূলত তার হাত ধরেই শুরু হয়েছে। আজতক বাংলার সঙ্গে এক্সক্লুসিভ আলাপচারিতায় টলিপাড়ার মেকআপের ম্যাজিশিয়ন সোমনাথ কুণ্ডু।
আজতক বাংলা: ইন্ডাস্ট্রিতে তো প্রায় দু' যুগের বেশি সময় পার করেছেন...
সোমনাথ কুণ্ডু: হ্যাঁ, প্রায় ১৯৯৪ থেকে স্ট্রাগল করেছি। ১৯৯৬ সালে কার্ড পেয়ে কাজ শুরু করেছি। সেই অর্থে প্রায় ২৫- ২৬ বছর হয়ে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে আমি স্বতন্ত্রভাবে চিফ মেকআপ আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি, ২০০০ সাল থেকে।
প্রশ্ন: সামনেই 'মহানন্দা' মুক্তি পাচ্ছে। ছবিতে আপনার করা কাজ দারুণ প্রশংসিত, এই মুহূর্তে অনুভূতিটা ঠিক কেমন?
সোমনাথ: ছবিটা সকলের ভাল লাগলেই আমার সবচেয়ে ভাল লাগবে। সকলকে এটাই অনুরোধ করব, সিনেমা হলে গিয়ে ছবিটা দেখুন।
প্রশ্ন: অভিনেত্রী গার্গী রায় চৌধুরী বলেছিলেন, তাঁর প্রস্থেটিক মেকআপ করতেই প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগত!
সোমনাথ: হ্যাঁ। আমরা একেবারে গরমকালে ছবির শ্যুটিং করেছি। তাপমাত্রা থাকত ৪৪ -৪৭ ডিগ্রির মতো। তার মধ্যে এরকম ভারী মেকআপ করা খুব কঠিন। সেটা করতেও একটা দীর্ঘ পদ্ধতি রয়েছে। যার প্রস্তুতি পর্ব চলেছে শ্যুটিং শুরুর আগে প্রায় দেড় মাস।
প্রশ্ন: মে মাসে 'আয় খুকু আয়' মুক্তি পাচ্ছে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের এই লুকটাও তো আপনি করেছেন, একেবারে চেনা যাচ্ছে না...
সোমনাথ: পরিচালক যা চেয়েছিলেন এবং গল্পের চাহিদা মতো বুম্বাদা-এর লুকটা করেছি।
প্রশ্ন: বর্তমানে কাজের জন্য এত প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। এই প্রস্থেটিক মেকআপের কাজ কতদিন আগে শুরু করেছিলেন?
সোমনাথ: অনেক দিন আগে থেকেই প্রস্থেটিকের কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম। যদিও এরপর অনেকদিন বসে থাকতে হয়। কেউ কাজ দিত না তখন। কেউ ভাবতেই পারত না, ছবিতে এই ধরনের কাজ হবে। আর যারা জানতেন, তাঁরা আমায় ভরসা করতেন না। বাইরে থেকে আর্টিস্ট নিয়ে আসতেন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে গত প্রায় ৫-৭ বছর আগে থেকে প্রস্থেটিক মেকআপ হচ্ছে। আমায় বিশ্বাস করলে, আমি তারও বছর পাঁচেক আগে এই কাজ করতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি... যদিও সম্পূর্ণ ভাবনাটা বদলে দিয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম শীলরাই।
প্রশ্ন: আপনার ঝুলিতে বহু কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুরুটা কোন ছবি দিয়ে?
সোমনাথ: 'গুমনামী', 'এক যে ছিল রাজা', 'ইয়েতি অভিযান', 'ভিঞ্চি দা', 'অপরাজিত' ছবিতে কাজের কথা তো সকলেই জানেন। তবে তার আগে আরও দুটো ছবিতে কাজ করেছিলাম প্রস্থেটিকের। ছবি দুটোর নাম ঠিক হয়নি তখন, মুক্তিও পায়নি এখনও, কোনও অজানা কারণে। একটা শুভশ্রীর লুক, আর একটা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মহাভারত নিয়ে তৈরি ছবিতে। তবে আমি বেশি পরিচিতি পেতে শুরু করেছি, 'জুলফিকর' আর 'এক যে ছিল রাজা' ছবিতে কাজের পর।
প্রশ্ন: আপনি এবং আপনার টিম ছাড়া এই মুহূর্তে কলকাতায় আর কেউ প্রস্থেটিকের কাজ করেন?
সোমনাথ: অনেকেই চেষ্টা করছেন। আমায় ফোন করে তাঁরা এই বিষয় জানতে চান। এমনকী শুধু নতুনরা না, অনেক সিনিয়ররাও চেষ্টা করছেন। আগে ইন্ডাস্ট্রির লোকেদের মাথায় ঢুকেছিল বোম্বের লোকেরা ছাড়া এই কাজ কেউ করতে পারবেন না। এখন সেটা কেটে গেছে অনেকটা। কলকাতাতে বাজেট ভেবেই ঝুঁকিটা নিতে চাইছেন তাঁরা।
প্রশ্ন: কোনও আক্ষেপ আছে এই নিয়ে?
সোমনাথ: এমন অনেক বড় ছবিও আছে যেখানে, আমায় ভরসা করতে পারেননি নির্মাতারা। যেমন 'ধূমকেতু' ছবির পরিচালক -প্রযোজক হয়তো ভেবেছিলেন বড় বাজেট আছে, বাইরে থেকে আর্টিস্ট আনতে হবে। আর যখনই কারও বাজেট কম থাকে, তখন কলকাতার কথা ভাবেন।
প্রশ্ন: চরিত্রের লুক তো ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলির মধ্যে একটি। সেই গুরু দায়িত্ব পালন করেন, অনেক পড়াশোনাও নিশ্চয় করতে হয়?
সোমনাথ: অবশ্যই। সবার আগে পরিচালক কী চাইছেন সেটা জানতে হয়। এরপর ভাবনা -চিন্তা শুরু হয়। যেমন' গুমনামী'-তে বুম্বাদা-এর লুক করার সময়, নেতাজির সঙ্গে কতটা মিল আনতে পারব সেটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আবার 'মহানন্দা'-তে গার্গীদি-এর ক্ষেত্রে, একেবারে মহাশ্বেতা দেবী হিসাবে তুলে ধরা হয়নি। ওঁকে ওই আদলে একটা লুক দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: এই যে প্রস্থেটিক মেকআপের সমস্ত সরঞ্জাম, তা কলকাতায় পাওয়া যায়?
সোমনাথ: না কলকাতায় কিছু জিনিস পাওয়া যায়, সবটা না। এগুলো মূলত বিভিন্ন মার্কিন উপাদান দিয়ে তৈরি। বোম্বেতে ডিস্ট্রিবিউটর আছে, তাঁদের বললে এনে দেয়।
প্রশ্ন: দামও তো তাহলে অনেক বেশি। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে ন্যায্য পারিশ্রমিক পান?
সোমনাথ: যে সব প্রযোজক খুব প্যাশনেট, তাঁরা সব রকমভাবে সহযোগিতা করেন। তবে আমিও বেশি খরচ না করানোর চেষ্টা করি। কারণ আমরা এখনও 'সেকেন্ড জেনারেশন মেকআপ মেটিরিয়াল' ব্যবহার করি। এর থেকে আরও উন্নত মানের মেকআপের সরঞ্জাম ব্যবহার করার জন্য, আরও অনেক বেশি ঠাণ্ডা আবহাওয়া লাগে। আমরা এখন সিলিকনে কাজ করছি, কিন্তু ওটা দিয়ে করতে পারলে আরও আসল মনে হবে লুক। তবে আমি অতিরিক্ত বেশি টাকা দাবি করি না। কারণ বাংলা ছবির উন্নতির জন্য আমি কাজ করতে চাই। প্রস্থেটিক করি বলে হয়তো অন্যদের থেকে একটু বেশি লাগে। তবে সত্যি কথা বলতে, আমি শ্যুটিংয়ের পারিশ্রমিক টুকু নেই এবং মেকআপ করাটা এনজয় করি।
প্রশ্ন: দেশের অন্যান্য অনেক ছবিতে প্রস্থেটিক লুক নিয়ে বিতর্ক হয়, আপনার কাজ নিয়ে ভয় লাগে?
সোমনাথ: আমার কাজ নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। কারও ভাল লাগবে, কারও হয়তো ভাল লাগল না। আমরা চেষ্টা করি যতটা সম্ভব ভাল কাজ করা যায়।
প্রশ্ন: বাইরে তো এই কাজের দর অনেক বেশি কলকাতার থেকে। টলিউডের বাইরেও কাজ করার ইচ্ছে আছে?
সোমনাথ: বাইরে কাজ করার ইচ্ছে টাকা রোজকারের জন্য না। আমি বাংলা থেকে উঠেছি, তাই এই ইন্ডাস্ট্রির জন্যই মূলত কাজ করব। তবে কিছু কাজ করতে ভাল লাগে। গত বছর রীনা দি (অপর্ণা সেন)-এর একটা কাজ করলাম যেটা বুসন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেয়েছে। এই ছবির জন্য কঙ্কনা সেনশর্মার প্রস্থেটিক মেকআপ করেছিলাম। এরকম আরও দু-তিনটে অফার আছে। আরও সুযোগ পেলে নিশ্চয় করব।