কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে এক জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যার মামলায় সিবিআই সম্প্রতি তাদের প্রথম চার্জশিট দাখিল করেছে। এই ৪৫ পৃষ্ঠার চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, যা তার অপরাধকে স্পষ্ট করে। এই মামলাটি পুরো কলকাতা জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যেখানে সন্দীপ ঘোষসহ বেশ কয়েকজনের ভূমিকা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত চার্জশিটে রায় একাই মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
প্রথম চার্জশিট এবং সিবিআই-এর অবস্থান
জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় প্রথমে সন্দীপ ঘোষকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যার ফলে তিনি এবং তালা থানার ইনচার্জ অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে, আশ্চর্যের বিষয় হল, সিবিআই চার্জশিটে সন্দীপ ঘোষের নাম অনুপস্থিত, যা কলকাতা পুলিশের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। যদিও তদন্তে তাকে এবং অভিজিৎ মণ্ডলকে প্রমাণ লোপাট ও ঘটনাস্থলের আলামত ধ্বংসের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তারা চার্জশিটের বাইরে রয়ে গেছেন। এতে পুলিশের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে কারণ তারাই সন্দীপ এবং অভিজিৎকে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে, ভবিষ্যতে তাদের নাম দ্বিতীয় চার্জশিটে থাকতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে ১১টি প্রমাণ
সিবিআই-এর চার্জশিট সঞ্জয় রায়কে কেন্দ্র করে, এবং তার বিরুদ্ধে মোট ১১টি প্রমাণ দাখিল করা হয়েছে। এই প্রমাণগুলি প্রমাণ করে যে সঞ্জয় রায়ই জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুন করেছে।
সিসিটিভি ফুটেজ: ৮ ও ৯ আগস্ট রাতে সিসিটিভি ফুটেজে সঞ্জয় রায়কে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের তৃতীয় তলার জরুরি বিভাগের কাছে দেখা গেছে, যেখানে ঘটনা ঘটেছিল।
কল ডিটেইল রেকর্ড: সঞ্জয় রায়ের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড এবং অবস্থান তথ্য দেখায় যে, তিনি ঘটনার সময় ওই ভবনে উপস্থিত ছিলেন।
ডিএনএ প্রমাণ: পোস্টমর্টেমের সময় নিহত জুনিয়র ডাক্তারের দেহ থেকে সঞ্জয় রায়ের ডিএনএ পাওয়া গেছে।
রক্তের চিহ্ন: সঞ্জয় রায়ের প্যান্ট এবং চপ্পলে নিহতের রক্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা পুলিশ পরে তার নির্দেশে উদ্ধার করে।
ফরেনসিক প্রমাণ: ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া চুলের টুকরোগুলি ফরেনসিক তদন্তে সঞ্জয় রায়ের বলে চিহ্নিত হয়েছে।
ব্লুটুথ ইয়ারফোন: ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ব্লুটুথ ইয়ারফোনটি সিসিটিভি ফুটেজে সঞ্জয় রায়ের গলায় দেখা গেছে, যা অপরাধের পর সেখানে পাওয়া যায়।
শরীরে আঘাতের চিহ্ন: সঞ্জয় রায়ের শরীরে আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে, যা ৮-৯ আগস্টের ঘটনার সময় সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আত্মরক্ষার চিহ্ন: ডাক্তারি পরীক্ষা অনুযায়ী, সঞ্জয় রায়ের শরীরে পাওয়া আঘাতগুলি আত্মরক্ষার প্রচেষ্টায় শিকারের দ্বারা করা হয়েছে।
মিথ্যা দাবি: সঞ্জয় রায় দাবি করেছিলেন যে তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম, কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় তার সেই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করা হয়েছে।
ফরেনসিক সুতো প্রমাণ: অপরাধস্থলে পাওয়া জুনিয়র ডাক্তারের অন্তর্বাসে সঞ্জয় রায়ের জামাকাপড়ের সুতো পাওয়া গেছে।
কাপড় ছিঁড়ে যাওয়ার প্রমাণ: ধর্ষণের সময় জুনিয়র ডাক্তারের কুরতি ছিঁড়ে যাওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
ময়নাতদন্ত এবং ফরেনসিক বোর্ডের সিদ্ধান্ত
ময়নাতদন্ত নিয়েও অনেক সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। আরজি কর হাসপাতালেই জুনিয়র ডাক্তারের ময়নাতদন্ত হয়েছিল, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। সিবিআই এরপর ময়নাতদন্তের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য AIIMS-এর একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে। বোর্ড ময়নাতদন্তের ভিডিওগ্রাফি ও তথ্য পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ময়নাতদন্ত যথাযথভাবে হয়েছে এবং তাতে কোনো ভুল হয়নি।
ভবিষ্যত দিক
সিবিআইয়ের এই চার্জশিট কেবলমাত্র প্রথম ধাপ। ভবিষ্যতে এই মামলায় আরও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, এবং দ্বিতীয় চার্জশিটেও সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের নাম আসতে পারে। তবে আপাতত, সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত প্রমাণগুলি তাকে জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করছে।
এই মামলার তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা এবং প্রমাণের ভিত্তিতে সঞ্জয় রায়ের অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। ১১টি শক্তিশালী প্রমাণের মাধ্যমে সিবিআই আদালতে একটি সুসংহত মামলা গঠন করেছে। তবে, সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে আনিত প্রাথমিক অভিযোগগুলি এখনও প্রশ্নের মুখে রয়েছে, এবং এটি ভবিষ্যতে মামলাটিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।