
দিল্লি বিস্ফোরণের তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেল নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। জইশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি উমর মহাম্মদ সম্ভবত ছিল 'জুতো বোমারু'। তাঁর গাড়ির একটি জুতো থেকেই উদ্ধার হয় বিস্ফোরকের চিহ্ন। যা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্তে উঠে এসেছে, ব্যবহৃত বিস্ফোরকটি ছিল বিশ্বের কুখ্যাত TATP-যা বহু আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলার সঙ্গে যুক্ত।
TATP কী? কেন একে বলা হয় ‘শয়তানের মা’?
TATP বা ট্রায়াসিটোন ট্রাইপেরক্সাইড এক ধরনের ঘরে তৈরি বিস্ফোরক। রাসায়নিকভাবে অত্যন্ত অস্থির এবং সামান্য তাপ, ঘর্ষণ কিংবা স্থির বিদ্যুতের স্পর্শেই বিস্ফোরিত হতে পারে। এ কারণেই বিশেষজ্ঞরা একে বলেন 'Mother of Satan'।
সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল, এর উপাদান সহজলভ্য, ফলে ফিঁদায়ে জঙ্গি ও স্লিপার সেলগুলির কাছে এটি জনপ্রিয়। লন্ডন, প্যারিস থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক হামলায় এই বিস্ফোরকের জোগসূত্র মিলেছে।
TATP-এর আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য, বিস্ফোরণের পর এটি খুব সামান্য চিহ্ন রেখে যায়। ফলে তদন্তকারীদের জন্য বিস্ফোরক শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
মাত্র ১০ গ্রাম TATP: ক্ষতি কতটা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০ গ্রাম TATP খুব ছোট বিস্ফোরণ ঘটায়, কিন্তু তার প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। TNT-এর ক্ষমতার ৫৫–৭০% সমান শক্তি উৎপন্ন করতে পারে এই স্বল্প পরিমাণ পদার্থ। তুলনামূলকভাবে, ১০ গ্রাম TATP মানে প্রায় ৬-৭ গ্রাম TNT-এর বিস্ফোরণ শক্তি।
১০ গ্রাম TATP-এর বিস্ফোরণের বৈজ্ঞানিক প্রভাব
(হপকিন্সনের স্কেলিং সূত্র অনুযায়ী)
প্রাণঘাতী ব্যাসার্ধ (১৫ PSI চাপ): ০.২২ মিটার
অর্থাৎ, বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে মাত্র ২২ সেন্টিমিটার দূরে থাকা মানুষ তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারাতে পারেন। ফুসফুস ফেটে যাওয়া বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আঘাতের ব্যাসার্ধ (৫ PSI চাপ): ০.৪৫ মিটার
৪৫ সেন্টিমিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি কানে আঘাত, মাথাব্যথা, শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা অনুভব করতে পারেন।
ক্ষতির ব্যাসার্ধ (১ PSI চাপ): ০.৯১ মিটার
প্রায় ১ মিটার দূরের জানালা বা হালকা দরজা ভেঙে যেতে পারে, ছোট আসবাবপত্র নড়ে উঠতে পারে। বিস্ফোরণ শক্তি এত দ্রুত কমে যায় যে ১ মিটারের পর এটি সাধারণ বায়ু তরঙ্গের মতো হয়ে যায়।
তুলনা: মানবদেহ, বস্তু ও TNT
মানুষ: হাতে বা জুতোর ভেতর বিস্ফোরণ হলে নিশ্চিত মৃত্যু। পাশে ১–২ জন গুরুতর আহত হতে পারেন।
বস্তু: ঘরোয়া জিনিসপত্র ও কাঁচ ভেঙে যায়, তবে গাড়ি বা কংক্রিট কাঠামোর বড় ক্ষতি হয় না।
TNT-এর সঙ্গে তুলনা:
১০ গ্রাম TNT-এর প্রাণঘাতী ব্যাসার্ধ ০.২৬ মিটার- TATP একটু কম শক্তিশালী হলেও অনেক বেশি অস্থির ও দুর্ঘটনাপ্রবণ।
২০০১ সালের 'জুতো বোমা' হামলাকারী রিচার্ড রিড জুতোর মধ্যে প্রায় ১০০ গ্রাম TATP বহন করেছিলেন। বিস্ফোরণটি সম্পূর্ণ হলে বিমানে থাকা ১০–২০ জন মারা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
দিল্লি বিস্ফোরণের তদন্ত: জুতো, গাড়ি এবং বিস্ফোরকের আলামত
উমর মহম্মদের আই-২০ গাড়ির চালকের আসনের নীচে এবং সামনের টায়ারের কাছে একটি জুতো উদ্ধার হয়। জুতোটিতে ধাতব বস্তু ও TATP-এর চিহ্ন পাওয়া গেছে।
গাড়ির পিছনের সিটের নীচেও বিস্ফোরকের নমুনা মিলেছে। প্রাথমিক ধারণা- জৈশ জঙ্গিরা বড়সড় হামলার পরিকল্পনায় প্রচুর পরিমাণ TATP মজুত করেছিল। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে TATP মিশিয়ে আরও শক্তিশালী বিস্ফোরক বানানো হয়েছিল। তদন্তকারীদের মতে, এই বিস্ফোরণ ছিল বড় হামলার পূর্বসূচনা, তবে বিস্ফোরক অল্প পরিমাণ হওয়ায় ক্ষতি সীমিত হয়েছে।
TATP-র সংবেদনশীলতা, সহজলভ্য উপাদান এবং উচ্চ বিস্ফোরণশক্তির কারণেই এটি বর্তমান যুগে জঙ্গি হামলার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রগুলির একটি। দিল্লির ঘটনাটি দেখিয়ে দিল- অল্প পরিমাণ TATP-ও কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, এবং একটি বড় জঙ্গি ষড়যন্ত্র কতটা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছে।