
অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের দিক থেকে ক্রমশ স্বাবলম্বী হচ্ছে ভারত। দীর্ঘদিন ধরে ভারত অস্ত্রের ক্ষেত্রে বিদেশের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন 'আত্মনির্ভর ভারত' এবং 'মেক ইন ইন্ডিয়ার' প্রকল্পে নিজেরাই অনেক অস্ত্র তৈরি করছে। অর্থাৎ এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান এবং ছোট ছোট যন্ত্রাংশ। কতটা স্বদেশীকরণ করা হচ্ছে? কোন অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা বন্ধ হয়েছে? আসুন জানি তথ্য।
ভারতের প্রতিরক্ষা খাত আগে ৬০-৭০% বিদেশি অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর ২০১৪-১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক ছিল, যা বিশ্বব্যাপী আমদানির ৯.৫%।
তবে ভালো খবর হল গত কয়েক বছরে এই অবস্থার বড়সড় পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ সালে আমদানি ছিল ৪১.৮%, যা ২০২০-২১ সালে কমে হয় ৩৬%। ২০২৩-২৪ সালে, প্রতিরক্ষা মূলধন বাজেটের ৭৫% দেশীয় ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। ২০১৬-২০ সালে, ভারত বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের ৯.৫% আমদানি করেছিল। ২০১৩-১৭ সালের তুলনায় ২০১৮-২২ সালে আমদানি ১১% কমেছে।
দেশীয়করণ সূচক (SRI) অর্থাৎ মোট প্রতিরক্ষার জিনিস কেনার ক্ষেত্রে দেশীয় অংশ ৩০% ছিল ১৯৯২ সালে। তবে ২০০৫ সালের তা বাড়িয়ে ৭০% করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছিল। এখন তা প্রায় ৬৫%। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৪,৬৬৬ টিরও বেশি জিনিস (যেমন ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার এবং খুচরো যন্ত্রাংশ) দেশে প্রস্তুত করা হবে। ইতিমধ্যেই ২,৭৩৬টি জিনিস দেশীয়করণ করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, এখন ১০১ এবং ১০৮টি পণ্যের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যেগুলোর আমদানি ২০২০-২৭ সালের মধ্যে নিষিদ্ধ করা হবে।
কোন অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশ আর আমদানি করা হয় না?
ভারত দেশীয়ভাবে অনেক বড় অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ছোটো যন্ত্রাংশ তৈরিতে সফল হয়েছে। এই কাজটি DRDO (প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা), DPSU (প্রতিরক্ষা পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং) এবং বেসরকারি কোম্পানি (যেমন টাটা, L&T এবং ভারত ফোর্জ) যৌথভাবে করেছে। কী কী আমদানি করা হয় না তার তালিকা দেওয়া হল-
১) মিসাইল:
আকাশ মিসাইল সিস্টেম : এই মিসাইল ২৫-৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত শত্রুর বিমান ধ্বংস করতে পারে। এটি ব্যবহারে ৬০% এরও বেশি দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র: ভারত ও রাশিয়ার যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি ব্রহ্মোস। তবে এখন এর বেশিরভাগ উৎপাদন ভারতেই হয়। মায়ানমার, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনেও ব্রহ্মোস রপ্তানি করেছে ভারত।
নাগ ট্যাঙ্ক-বিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র: ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সম্পূর্ণরূপে ভারতে ডিজাইন করা এবং তৈরি।
পিনাকা মাল্টি-ব্যারেল রকেট লঞ্চার: এটি ৪০-৯০ কিলোমিটার পাল্লার রকেট সিস্টেম, আর্মেনিয়ায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারে রপ্তানি করা হয়েছে।
অগ্নি সিরিজ (১,২,৩,৪,৫): দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, এটি সম্পূর্ণরূপে দেশীয় প্রযুক্তিতৈ তৈরি ।
রুদ্র-এম-II ক্ষেপণাস্ত্র: এটি আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। ২০২৪ সালে এর সফল পরীক্ষা করা হয়।
২. বিমান এবং হেলিকপ্টার :
লাইট কম্বোট এয়ারক্রাফ্ট (LCA) তেজস: ভারতীয় বিমান বাহিনীর দেশীয় ফাইটার জেট, HAL (হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড) দ্বারা নির্মিত। এতে ৬০% দেশীয় উপাদান রয়েছে, যদিও GE F404 ইঞ্জিন বর্তমানে আমেরিকা থেকে আসে। DRDO এখন কাবেরি ইঞ্জিন তৈরি করছে।
ALH ধ্রুব: অনুসন্ধান, উদ্ধার এবং যাতায়াতের জন্য তৈরি হয় এই হেলিকপ্টার। তা ইতিমধ্যেই ইকুয়েডরে রপ্তানি করা হয়েছে।
LCH প্রচণ্ড: লাদাখের মতো উচ্চভূমিতে আক্রমণ এবং নজরদারির জন্য দেশীয় হেলিকপ্টার।
রুদ্র: ধ্রুবের সশস্ত্র সংস্করণ, যা ট্যাঙ্ক এবং শত্রু অবস্থানে আক্রমণ করে।
৩) নৌ সরঞ্জাম:
INS বিক্রান্ত: কোচিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড (CSL) দ্বারা নির্মিত ভারতের প্রথম দেশীয় বিমানবাহী রণতরী। ৮০% দেশীয় উপকরণ এতে ব্যবহার করা হয়।
বরুণাস্ত্র টর্পেডো: সাবমেরিন ধ্বংস করার জন্য টর্পেডো, DRDO দ্বারা নির্মিত।
Maareech এবং Ushus: নৌবাহিনীর জন্য অ্যান্টি-টর্পেডো সিস্টেম এবং সোনার, সম্পূর্ণ দেশীয়।
TAL শায়েন টর্পেডো: হালকা টর্পেডো, মায়ানমার এবং ভিয়েতনামের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
NISTAR: নৌবাহিনীর প্রথম দেশীয় ডাইভিং সাপোর্ট জাহাজ, ৮০% দেশীয় উপকরণে তৈরি।
৪) ট্যাঙ্ক এবং কামান
অর্জুন MBT Mk1A: দেশীয় প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্ক, DRDO দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছে। এতে আগের তুলনায় আরও বেশি দেশীয় উপাদান রয়েছে।
ATAGS (অ্যাডভান্সড টাউড আর্টিলারি গান সিস্টেম): ১৫৫ মিমি বন্দুক, যার জন্য ২০২৫ সালে ৭,০০০ কোটি টাকার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল।
৪৬-মিটার মডুলার সেতু: সেনাবাহিনীর জন্য সেতু, সম্পূর্ণরূপে ভারতে তৈরি।
১৫৫ মিমি আর্টিলারি শেল: ভারত ফোর্জ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৪০০০০ এবং ৫০০০০ শেল সরবরাহ করেছে।
৫) রাডার এবং ইলেকট্রনিক্স
সেন্ট্রাল অ্যাকুইজিশন রাডার (CAR): বাতাসে শত্রু বিমান ট্র্যাক করার জন্য রাডার।
অস্ত্র সনাক্তকরণ রাডার (WLR): শত্রুদের বন্দুকের অবস্থান খুঁজে বের করে।
LLTR আশ্বিন: নিম্ন-স্তরের ট্র্যাকিং রাডার, যা বাতাসে কম উচ্চতায় উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তু সনাক্ত করে।
AEW&C (এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল): রিকনেসান্স এবং নজরদারির জন্য সিস্টেম।
৬. ছোটো যন্ত্রাংশ
এয়ারক্রাফ্ট পেইন্ট: আগে আমদানি করা হত, এখন ভারতে তৈরি।
কার্গো নেট এবং হেলিকপ্টার স্লিং: হেলিকপ্টারের জন্য পণ্য বহনের জাল এবং দড়ি।
প্যারাসুট, বিস্ফোরক এবং পোশাক: সামরিক বাহিনীর জন্য বিশেষ পোশাক এবং প্যারাসুট, এখন ৩০ টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়।
এআই-চালিত ড্রোন: অপারেশন সিন্দুরে ব্যবহৃত ড্রোন, ভারতে ডিজাইন এবং তৈরি।
আমদানি নির্ভরতা: তবে ভারত অস্ত্র তৈরিতে এখনও স্বনির্ভর হতে পারেনি। উৎপাদন এবং প্রযুক্তির অভাবের কারণে ২০১৮-২২ সালে ভারত শীর্ষ ২৫টি অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ভারত এখন কেবল নিজের জন্য অস্ত্র তৈরি করছে না ৩০টিরও বেশি দেশে রপ্তানিও করছে।
২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি: সরকার প্রতিরক্ষায় রপ্তানি ২১,০৮৩ কোটি টাকা থেকে ৫০,০০০ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে।