এনডিএ-র সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফের মহাগটবন্ধনে ফিরে গিয়েছেন নীতীশ কুমার। আর যেভাবে তিনি গোটা পরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন সেটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কার্যত আকারে ইঙ্গিতে নীতীশ বুঝিয়ে দিয়েছেন, ২০২৪-এ লড়াইতে তিনিও বিপক্ষের মুখ হতে পারেন। তবে সেই দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও রয়েছেন বলে মত রাজনৈতিকমহলের। আর সেক্ষেত্রে এই ৪ জনের প্রত্যেকেরই রয়েছে কিছু বিশেষ বিশেষত্ব এবং দুর্বলতা। চলুন দেখে নেওয়া যাক সেগুলিই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তি
মহিলাদের সমর্থন
১. তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই তাঁর যে ক্ষমতার কথা উঠে আসে তা হল মহিলা ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা। বর্তমান দেশের একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতার মহিলাদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। আর এই মহিলা ভোটারদের সমর্থনের কারণেই ২০২১-এ বঙ্গ জয় করতে পারেনি বিজেপি।
দখলে অর্ধেকের বেশি লোকসভা আসন
২. বাংলায় রয়েছে ৪২টি লোকসভা আসন। তারমধ্যে বর্তমানে অর্ধেকেরও বেশি আসন রয়েছে তৃণমূলের দখলে। বিধানসভা ভোটেও নিজের আধিপত্য বজায় রেখে ঘাসফুল শিবির। আর এটাই ২০২৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাড়তি মাইলেজ দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জননেত্রীর ভাবমূর্তি
৩. দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এক নিজেকে জননেত্রী হিসেবে তুলে ধলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে গরীব দরদী এক ভবমূর্তিও বজায় রেখেন মমতা। যা বারেবারই নির্বাচনের সময় তাঁর আলাদা শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্বলতা
১. হিন্দি-ইংরেজির সমস্যা
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে জাতীয় স্তরে নেতৃত্বের পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল ভাষা। তাঁর হিন্দি খুব একটা মজবুত না, ফলে হিন্দিভাষীদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একই সমস্যা দেখা দেয় ইংরেজির ক্ষেত্রেও।
২. পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বারেবারেই নিজের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরার চেষ্টার অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। এমনকি দলের অনেক শীর্ষ নেতার পরিবর্তে তিনি অভিষেককে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলেও অভিযোগ।
৩. দুর্নীতির অভিযোগ
রাজনৈতিকমহল মনে করছে ২০২৪-এর লড়াইতে মমতাকে সবচেয়ে বেশি ভোগাতে পারে দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। ইতিমধ্যেই এসএসসি দুর্নীতিতে গ্রেফতার করা হয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। গরুপাচারকাণ্ডে গ্রেফতার অনুব্রত মণ্ডল। এমনকি কয়লা পাচার মামলাতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের শক্তি
১. দলে যুবশক্তি
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আপ প্রধান তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলে যুবশক্তির প্রাধান্য রয়েছে। উৎসাহ উদ্দিপনায় ভরপুর রয়েছেন দলের নেতা কর্মীর, যা তাঁকে ২০২৪-এ বিশেষ সুবিধা করে দিতে পারে।
২. দুর্নীতি বিরোধী মুখ
দুর্নীতির বিরোধিতা করে আম আদমি পার্টি গড়ে তুলেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এমনকি দলের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাঁকে রেয়াত করেননি। আর তাঁর এই দুর্নীতি বিরোধী ভাবমূর্তিই আগামী লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক মাইলেজ দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দুর্বলতা
১. সংগঠনের ক্ষমতা কিছু মানুষের হাতে
কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে নিজের ঘনিষ্ঠ মানুষদের হাতেই সংগঠনের ক্ষমতা দেওয়া অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ দলের সংগঠন পরিচালনা করেন মুষ্ঠিমেয় মানুষ, যা বৃহত্তর ক্ষেত্রে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সমস্যায় ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২. ওয়ান ম্যান শো
জনমানসে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে তাঁর পাশাপাশি দলে এবং সরকারে দ্বিতীয় কোনও মুখকে সেভাবে উঠে আসতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে কেজরিওয়াল দলের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে চান না বলেও অভিযোগ করেন তাঁর বিরোধীরা। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে আপ হল ওয়ান ম্যান শো।
রাহুল গান্ধীর ক্ষমতা
১. সবচেয়ে বড় বিরোধী নেতা
নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে সারা দেশে সবচেয়ে বড় বিরোধী নেতা হলেন রাহুল গান্ধী। সংসদের উভয় কক্ষেই সবচেয়ে বেশি বিরোধী সাংসদও রয়েছে কংগ্রেসেরই। আর এটাও ঠিক, কংগ্রেসকে ছাড়া বিরোধী ঐক্য কার্যত অসম্ভব। সেক্ষেত্রে এটাই রাহুল গান্ধীর সবচেয়ে বড় ক্ষমতা বলে মনে করা হচ্ছে।
২. লাগাতার মোদীকে আক্রমণ
বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় বারেবারেই দেখা গিয়েছে রাহুল গান্ধীকে। সংসদের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন সম প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন রাহুল। সেই দিক থেকে আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদীকে রাহুলও কড়া টক্কর দিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রাহুল গান্ধীর দুর্বলতা
১. পরিবারবাদের অভিযোগ
গান্ধী পরিবারের সদস্য রাহুল গান্ধী। আর রাজনীতিতে সেটাই রাহুল গান্ধীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ রাহুল গান্ধীকে যুবরাজ বলে বারেবারেই কটাক্ষ করে বিজেপি। এমনকী পরিবারবাদ ইস্যুতেও বারেবারেই রাহুলকে বিঁধেছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য বিজেপি নেতারা।
২. সর্বক্ষণ সক্রিয় নয়
মাঝেমধ্যেই রাজনীতির ময়দানে পাওয়া যায় না রাহুল গান্ধীকে। যা নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়েন না বিজেপি নেতারা। সেক্ষেত্রে ২৪x৭ রাজনৈতিক নেতা হিসেব নিজেকে তুলে ধরতে কার্যত ব্যর্থ রাহুল গান্ধী।
নীতীশ কুমারের শক্তি
১. হিন্দিভাষীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা
জেডিইউ প্রধান তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার হিন্দিভাষীদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় নেতা। আর দেশের একটা বড় অংশের ভোটার হিন্দিভাষী। তাই দিল্লি দখল করতে গেলে বৃহদাংশের হিন্দিভাষীদের সমর্থন প্রয়োজন হবে। সেই দিকে বেশখানিকটা এগিয়েই রয়েছেন নীতীশ কুমার।
২. দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা
মোট ৮ বার বিহারে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নীতীশ কুমার। এছাড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন। তাই সরকার চালানোর একটা বড়সড় অভিজ্ঞতা রয়েছে নীতীশের। আর এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নীতীশকে ২০২৪-এ বিরোধীদের মুখ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নীতীশ কুমারের দুর্বলতা
১. অবিশ্বাসের অভিযোগ
আট বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হলেও বারেবারেই শরিকদের হাত ছেড়ে উল্টোদিকে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে একবার এনডিএ ছেড়ে মহাগটবন্ধনে যোগ দেন। তারপর ফের ফেরেন এনডিএতে। এবার আবারও সেই মহাগটবন্ধনেই যোগ দিলেন নীতীশ। বারেবারে শিবির বদলানো তাঁর গায়ে অবিশ্বাসী তকমা জুড়ে দিয়েছে বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
২. জাতীয় স্তরে ভিত্তি নেই
দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে জাতীয় স্তরের নেতা হিসেবে তুলে ধরতে ব্যর্থ নীতীশ কুমার। আর এটা তাঁকে ২০২৪-এ বিরোধীদের মুখ হয়ে ওযার ক্ষেত্রে পিছিয়ে দিতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।