বিহার বিধানসভার ফল প্রায় ৩ দশক ধরে বিহারে রাজনীতিতে দাপট দেখিয়েছে RJD-র 'MY' ইক্যুয়েশন। 'MY' অর্থাৎ Muslim-Yadav। তবে ২০২৫ সাল বিহারে আনল নয়া ইক্যুয়েশন। এবার রাজত্ব করবে 'ME'। এই 'ME'-এর অর্থ, Mahila and EBC. আর এই 'ME' ইক্যুয়েশনের উপর ভর করেই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রত্যাবর্তন করল NDA। সামাজিক উন্নয়ন, লিঙ্গ এবং আকাঙ্খার উপর ভিত্তি করে নয়া এই ইক্যুয়েশন NDA-র জন্য ক্লিক করে গেল বিহারে। যেখানে এতকাল ভোট হত জাতপাত বিচার করে।
NDA-র বিহার ক্যাম্পেন ৩টি ফ্যাক্টরের উপর দাঁড়িয়েছিল। মহিলা ভোট এবং নীতীশের প্রতিচ্ছবি, জাতপাতের রাজনীতি এবং চিরাগ পাসওয়ানের ওয়াপসি ও উপেন্দ্র কুশওয়াহা এবং যুব সম্প্রদায়। 'কাট্টা, দুনালি, রঙ্গদারি' শব্দগুলি বারবার ব্যবহার করেছে NDA। বোঝাতে চেয়েছে বিহারে আগে আইনশৃঙ্খলা কতটা খারাপ ছিল।
অন্যদিকে, মহাগঠবন্ধন জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রচার চালাতে পারেনি বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। মুসলিম এবং যাদবদের বাইরে বেরিয়ে ক্যাম্পেনে আর কারও জন্য কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল না। 'ভোট চুরি' ইস্যু ছাড়া তাদের আর কোনও হাতিয়ারও দেখা যায়নি। এমনকী NDA-ও 'MY' ভোটারদের একটা অংশ নিজেদের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে।
জাতপাতের রাজনীতি
এই নির্বাচন স্পষ্ট প্রমাণ করেছে ১৯৯৫ সালের বিহারে মুসলিম-যাদব ইক্যুয়েশনের দাপট থাকলেও ২০২৫ সালে এসে সেই দাপট ফিকে হয়ে গিয়েছে। NDA-র জাতপাতের ছাতাটা এবার অনেকটাই বড় ছিল। BJP উচ্চজাতের ভোট পেয়েছে। আবার নীতীশ কুমার পেয়েছেন EBC (Economically Backward Class) ভোট। সেটাই হয়ে উঠেছে এবারের ভোটের এক্স ফ্যাক্টর। রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চার কুশওয়াহা, LJP-র পাসওান এবং হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চার দলিত ফ্যাক্টর আরও বুস্ট আপ করেছে জোটের প্রচারকে।
পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলো ২০২০ সালের নির্বাচনের তুলনায় NDA-র এই উত্থানের পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। বিহার সরকারের প্রকাশিত জাতিগণনা অনুযায়ী, EBC-রা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬%। NDA এবং কুর্মি সম্প্রদায়ভুক্ত (জনসংখ্যার প্রায় ৩%) নীতীশ কুমার বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে এই বিশাল ভোটব্যাঙ্ককে নিজেদের পক্ষে টেনে এনেছেন। এটি JDU-র জন্য নাটকীয় প্রত্যাবর্তন। ২০২০ সালে EBC ও তফসিলি জাতিভিত্তিক জনসংখ্যা বেশি এমন আসনগুলোর অনেকগুলোতেই হারতে হয়েছিল JDU-কে। ১১৫টি আসনে লড়ে তারা জিতেছিল মাত্র ৪৩টিতে। এবার সেই সংখ্যা বেড়ে ৭০-এর অনেক উপরে।
মহিলা ভোটার
গত পাঁচ বছরে বিহারে নারীরা এক নতুন ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে উঠে এসেছেন। পরিচয় বা জাতিগত রাজনীতির চেয়ে উন্নয়ন ও সুযোগের ভিত্তিতে ভোট দিচ্ছেন তারা। ২০১০ সাল থেকে নারী ভোটদানের হার ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৫ সালে নারী ভোটদানের হার পুরুষদের তুলনায় ১০% বেশি ছিল। এই ফলাফল দেখিয়ে দিল যে তারা এখনও নীতীশের সবচেয়ে দৃঢ় সমর্থক। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নীতীশ কুমার নারীদের আলাদা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে তৈরির চেষ্টা করেছেন। বিদ্যালয়ের মেয়েদের সাইকেল প্রকল্প, মদ নিষিদ্ধকরণ আইন, এবং এবার 'দশ হাজারি' প্রকল্প বা মহিলা রোজগার যোজনার মাধ্যমে উদ্যোক্তা নারীদের ১০ হাজার টাকা বিতরণ। এসব তাদের ব্যাপকভাবে NDA-র পক্ষে করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে 'লাখপতি দিদি' প্রকল্প। এ থেকেই বোঝা যায়, বিহারের রাজনৈতিক ‘M’ আর মুসলিম নয়, বরং 'মহিলা'।
নিতীশ ফ্যাক্টর
NDA-র এই জয়ের তৃতীয় বড় কারণ স্বয়ং নিতীশ কুমার। তাঁর পরিচ্ছন্ন ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তিই NDA-র সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। ৭৪ বছর বয়সেও নিতীশ বিহারের রাজনীতিতে আগের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি NDA-র হয়ে ৮৪টি জনসভা করেছেন। ৩৯ বছরের তেজস্বীর চেয়ে মাত্র একটি কম। তেজস্বী তাঁর বয়স নিয়ে কটাক্ষ করে নিতীশ সরকারের বিরুদ্ধে 'খতরা সরকার' প্রচার করলেও তা ভোটারদের মনে সাড়া ফেলেনি। কারণ তারা নিজের চোখে দেখেছে নিতীশকে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে। এর পাশাপাশি সব গৃহস্থালি গ্রাহকদের জন্য ১২৫ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ এবং প্রবীণদের পেনশন ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ টাকা করা, ভোটের খেলায় বড় মোড় ঘোরানো সিদ্ধান্ত।
এসব মিলিয়ে নিতীশ কুমারকে আবারও ভোটারদের চোখে ‘সুশাসন বাবু’-র আসনে ফিরিয়ে এনেছে।