নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু রহস্য নিয়ে গোটা দেশে কম বিতর্ক নেই। কেউ বলেন তিনি তাইহোকু বিমানবন্দরে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা যান। কেউ বা আবার মনে করেন, না তখন তিনি মারা যাননি। রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর অবস্থা বুঝে আবারও ভারতে ফিরে আসেন। এবং উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে গুমনামি বাবার ছদ্মবেশ ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। এই প্রসঙ্গে আপনাদের জানিয়ে রাখি, ১৯৮৫ সালে মৃত্যু হয়েছিল এই গুমনামি বাবার। এবং তাঁর কাছ থেকে বেশ কয়েকটা চিঠি পাওয়া গিয়েছিল যার সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতের লেখার হুবহু মিল পাওয়া যায়। কিন্তু, এই বিতর্কের মাঝে আরও একটা ঘটনা যেন এই যজ্ঞের আগুনেই ঘৃতাহুতি করেছিল। আগামী ২৩ জানুয়ারি গোটা দেশজুড়ে এই মহান রাষ্ট্রনায়কের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হবে। তবে তার আগে আসুন, সেই বিশেষ ঘটনাটার কথা একবার জেনে নেওয়া যাক।
সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু বিতর্কের মধ্যে একটা হল সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবাদ সংস্থা TASS-এর একটি রিপোর্ট। এই খবরটাকে সত্যি বলে প্রচার করেছিল জার্মানির বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রও। তা কী ছিল সেই রিপোর্টে? না, সেই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে পঞ্চাশের দশকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সুভাষ চন্দ্র বসুকে দেখতে পাওয়া গেছে। এইমর্মে একটা ভিডিও ক্লিপও প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, পণ্ডিত জওহর লাল নেহরুর মৃতদেহের সামনে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরসঙ্গে নাকি সুভাষের মুখাবয়বের অনেকটাই মিল রয়েছে। বম্বে ফিল্ম ডিভিশন এই ভিডিওটি তৈরি করেছিল। জাতীয় সংগ্রহশালায় আজও ভিডিওটা রাখা আছে।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকু বিমানবন্দরে যদি নেতাজি মারা যান, তাহলে তিনি পণ্ডিত নেহরুর মৃত্যুতে কীভাবে সামনে এলেন? কারণ ১৯৬৪ সালের ২৭ মে মৃত্যু হয়েছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর। তাহলে কি মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টই ঠিক ছিল? যে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে কোনও বিমানই ওড়েনি। সেদিন কোনওমতেই নেতাজির মৃত্য়ু হতে পারে না। তাহলে কি ওই ব্যক্তিটি গুমনামি বাবা ছিলেন? তিনি কি নেহরুকে শেষবারের জন্য দেখতে এসেছিলেন? সেই জবাব এখনও পাওয়া যায়নি।
All those individuals, groups or parties who now participate in the fight for freedom will have an honoured place in the India of tomorrow … The supporters of British imperialism will naturally become non-entities in a free India…”__Netaji Subhas Chandra Bose on VD #Savarkar. pic.twitter.com/0OBaSQyvIP
— Nehruvian (@_nehruvian) May 27, 2020
তাহলে কে ছিলেন ওই ব্যক্তি? নেতাজি গবেষক অনুজ ধর তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে দাবি করেছেন, ওই ব্যক্তি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু কিংবা গুমনামি বাবা'র মধ্যে কেউ ছিলেন না। তিনি বললেন, "নেহরুর মৃত্যুর সময় ব্যাপারটা অতটাও কারোর নজরে পড়েনি। কিন্তু, বম্বে ফিল্ম ডিভিশন নেহরুর মৃত্যু নিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করে। যখন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটা দেখা হয়, তখন সকলে বলে ওঠেন, আরে ওই তো নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দাঁড়িয়ে আছেন। আর সেই জায়গা থেকে জল্পনা শুরু হয় যে তাহলে নেতাজি বোধহয় আজও বেঁচে আছেন।"
Remembering the Architect of Modern India, Jawaharlal Nehru on his death anniversary. pic.twitter.com/se08exIqR9
— Adv. Tufail Gilani (@GilaniTufail) May 27, 2020
এরপর তিনি এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে আরও খোলসা করলেন। তিনি বললেন, "এই ব্যক্তি আসলে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুই নন। কারণ ১৯৭০ সালে খোসলা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেখানেও এই বিষয়টা তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ওই কমিশনের সামনে যে অন্তিম সাক্ষী এসেছিলেন, তিনি হলেন বীরা ধামাওরা নামে কাম্বোডিয়ার এক সাধু। তিনি কমিশনের সামনে এসে স্বীকার করেন যে এটা তাঁরই ছবি। তিনিই পণ্ডিত নেহরুর মৃতদেহের সামনে সেদিন গিয়েছিলেন।"
এই প্রসঙ্গে আপনাদের জানিয়ে রাখি, বীরা ধামাওরা কাম্বোডিয়ার সাধু হলেও দিল্লিতে তাঁর একটি আশ্রম ছিল। সেইসঙ্গে তিনি পণ্ডিত নেহরুকেও যথেষ্ট ভালো করেই চিনতেন। ১১০ বছর ১৩৪ দিন তিনি বেঁচেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২৬ জুন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৩৪ বাবা জানকীনাথ বসুর মৃত্যুর পর নেতাজিকে গোটা মাথা ন্যাড়া করতে হয়েছিল। সেইসময় তাঁর একটি ছবিও তুলে রাখা হয়। সেই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে স্পষ্টই বুঝতে পারা যাবে, দুটো মুখের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। ফলে এই দাবিটি যে একেবারেই ভুয়ো তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ভিডিও কৃতজ্ঞতা - ইউটিউব (LONGLIVENETAJI)
নেতাজির মৃত্যু রহস্য আজও সকলের কাছে অজানা। তবে বীরের কখনও মৃত্যু হয় না। আজও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর ভাবাদর্শের বিচারে আমার প্রত্যেকের মধ্যেই বিরাজ করছেন। আগামীকাল তাঁর ১২৫তম জন্মদিন। আসুন আমরা সবাই মিলে এই দিনটাকে পালন করি।