নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো রাষ্ট্রনায়ক আমাদের দেশে খুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাকের স্বাধীনতা দেব"। তাঁর এই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন দেশের লাখো লাখো তরুণ যুবক। নিমেষে বাজি রাখার সাহস দেখিয়েছিলেন তরতাজা প্রাণ। চোখে তখন একটাই স্বপ্ন, ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা। নেতাজি কখনই জাতপাতের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর কাছে হিন্দুও যা ছিল, মুসলিমও তাই। খ্রীষ্টানও কোনও অংশে কম ছিল না। একবার তিনি নিজেই এই জাতপাতের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। আগামী ২৩ জানুয়ারি এমনই এক রাষ্ট্রনায়কের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হবে। আসুন তার আগে গল্পটা জেনে নেওয়া যাক।
তখন আজ়াদ হিন্দ ফৌজ় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরোদমে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নেতাজি তখন সিঙ্গাপুরে। তো, এমন একটা লড়াই করার জন্য যে প্রচুর পরিমাণে অর্থ লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আর্থিক অনুদান আসত। একবার হয়েছে কী, অনুদান দেবে বলে ঠিক করলেন সিঙ্গাপুরের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী ব্রিজলাল জয়সোয়াল।
যেমন কথা, তেমন কাজ। তিনি অনুদান দেওয়ার আগে নেতাজির সঙ্গে একবার দেখা করতে এলেন। সেইসময় নেতাজি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি সিঙ্গাপুরের ধনীদের মধ্যে অন্যতম। দেশের মাটির মানুষের সাহায্যে আমি সাহায্য করবেন। আপনাদের মতো মানুষরাই তো আদর্শ স্থাপন করবেন। তা দানটা কি আপনি করবেন, নাকি চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ করবে?" জবাবে জয়সওয়াল জানান, দানটা চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ করবে। কিন্তু তাঁর একটা ছোট্ট আবদার রয়েছে। কী সেই আবদার? না, নেতাজিকে তিনি বলেন যে যদি সুভাষ দয়া করে তাঁদের মন্দিরে পায়ের ধুলো দেন, তাহলে সেখানেই তাঁরা তাঁদের অনুদান হস্তান্তরিত করবেন। আর এমন ঘটনা সত্যি হলে তাঁরাও ধন্য হয়ে যাবেন।
A never seen before picture of Netaji, most likely taken at Singapore in 1943. This is courtesy Vandana Garhwal, who has a knack for locating rare pics and documents. 🙏 pic.twitter.com/3uqNpHbIMI
— Anuj Dhar (@anujdhar) February 12, 2020
জবাবে নেতাজি বলেছিলেন, পায়ের ধুলো দিতে নয়, বরং ভক্তদের সেই ধুলো তিনি নিজের মাথায় তুলতে যাবেন। সেইসঙ্গে তিনি আরও যোগ করেন, মাঝেমধ্যে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে যান বটে, তবে সেটা নেহাতই ব্যক্তিগত স্বার্থে। নেতাজি হিসেবে নয়, সুভাষ হয়ে। আজ়াদ হিন্দ ফৌজের অধিনায়ক হিসেবে তিনি কখনই কোনও মন্দিরে যেতে পারেন না। খানিকটা আশাহত হয়েই ব্রিজলাল এর কারণ জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন, সুভাষ চন্দ্র বসু হিন্দু হতে পারেন। কিন্তু, নেতাজি সবসময় ধর্মনিরপেক্ষ।
1940s :: Netaji Subhas Chandra Bose Speaking at Cathay Theatre , Singapore
— indianhistorypics (@IndiaHistorypic) June 2, 2018
(Photo -National Archives Singapore ) #IndiaSingapore pic.twitter.com/FxTxcZQV4F
এর পরের ঘটনাটি আরও বিস্ময়কর! সেদিন মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছিলেন ব্রিজলাল জয়সোয়াল। নেতাজি সত্যি সত্যিই মনে করেছিলেন যে তাঁর হয়ত অনুদান আর পাওয়া হল না। দলের সহযোদ্ধাদের তিনি সে কথা জানিয়েও ছিলেন। কিন্তু, পরেরদিন সকালে ঘটল চমৎকার। মন্দির কমিটির আরও জনাছয়েক কর্মকর্তাকে ফিরে এলেন ব্রিজলাল জয়সোয়াল। নেতাজির আবেদন তিনি মেনে নেন যে শুধুমাত্র তিনি নন, তাঁর মুসলমান, খ্রীষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুরাও যাবেন। সেব্যাপারে ব্রিজলাল কোনও আপত্তি জানাননি। অবশেষে, ২০০ বছরের পুরনো সংস্কারকে দূরে সরিয়ে রেখে করে সিঙ্গাপুরে চেট্টিয়া মন্দিরের দরজা সাধারণ ভারতবাসীর জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। সিঁড়ির ধাপের পাশে নেতাজী খুলে রাখলেন তার মিলিটারি টপবুট। দেখাদেখি প্রত্যেকেই তাঁদের জুতো ওই একই জায়গায় খুলে রেখেছিলেন। এরপর সদর্পে সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের ভিতর তাঁরা প্রবেশ করেন। সকলে একসঙ্গে বলে উঠেছিলেন 'জয় হিন্দ'।
76 years back, 1st Prov. Govt of Azad Hind was announced by Netaji at Singapore, as its 1st PM. A landmark never found place in history till PM Modi celebrated it last year to commemorate 75th Anniv. and acknowledged Netaji as 1st PM. The day be as important as our Indepence Day. pic.twitter.com/m477l6gIrz
— Sunil Saxena (@SunilSaxena1954) October 21, 2020
সবশেষে ব্রিজলাল শুধুমাত্র একটাই কথা আওড়েছিলেন। "নেতাজি, মায়ের চোখে কেউ মুসলমান নন, কেউ খ্রিস্টানও নন। ওরা প্রত্যেকে আসলে বন্দিনী মায়ের মুক্তিযোদ্ধা। আমরা ফুল দিয়ে অর্ঘ্য দি, ওনারা বুকের রক্ত দিয়ে অর্ঘ্য দেন। ওনারা আরও বড় জাতের ভক্ত।"