নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক গোটা দেশে আরও একজন পাওয়া বেশ দুষ্কর। কিন্তু, আপনি কি জানেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে নামার আগে আমাদের প্রিয় এই সুভাষ চন্দ্র বসু একটি বিদ্যালয়ে পড়াতেন। আর এই পড়ানোর জন্য কোনও পারিশ্রমিকও তিনি গ্রহণ করতেন না। আগামী ২৩ জানুয়ারি গোটা দেশে নেতাজির ১২৫তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হবে। তার আগে আমরা আপনাদের কাছে তাঁর অজানা কিছু গল্পের কথা তুলে ধরছি। আজও তেমনই একটা গল্প আপনাদের শোনাব। আসুন, তাহলে শুরু করা যাক।
আপনারা অনেকেই হয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমন্তকুমার সরকারের নাম শুনেছেন। বাড়ি ছিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। তিনি সুভাষের আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। তো, সেই সুবাদেই কৃষ্ণনগরে যাতায়াত ছিল তাঁর। তবে সম্পর্কের জাল এখানেই শেষ নয়। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করতেন এই হেমন্তকুমার। সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন বেনীমাধব দাস। এই বেনীমাধব দাসই পরে বদলি হয়ে ওড়িশার কটকে রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ফলে, সুভাষও তাঁর সান্নিধ্যে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯১২ সালে পুজোর ছুটিতে পুরী বেড়াতে এসেছিলেন হেমন্তকুমার। বেনীমাধব দাসের ইচ্ছায় তিনি কটকে আসেন এবং সুভাষের সঙ্গে দেখা করেন।
সেই ছিল প্রথম আলাপ। এরপর বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। পরবর্তীকালে নেতাজি 'ভারত পথিক' নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ে তিনি স্বীকার করেন, হেমন্ত কুমারের সান্নিধ্যে এসেই নাকি তাঁক প্রথম রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। সেকথা না হয় পরে কোনও একদিন আলোচনা করা যাবে।
ছোটোবেলা থেকেই হেমন্ত কুমারের মধ্যে একটা বৈপ্লবিক মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। সেটা প্রথম সাক্ষাতেই সুভাষ বেশ ভালো বুঝতে পেরেছিল। পরের বছরই সুভাষকে কৃষ্ণনগরে আমন্ত্রণ জানান হেমন্ত কুমার। ততদিনে সুভাষেরও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। তো, কৃষ্ণনগর যেতে তাঁর কোনও বাধাই ছিল না। তিনি সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তবে সুভাষের সঙ্গে আরও একদল ছাত্র এসেছিলেন নদীয়ায়। তাঁরা সকলে মিলে নদীপথে পলাশি সহ বহরমপুরের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখেন। এই দলে ছিলেন যুগলকিশোর আঢ্য, সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুদাস গুপ্ত, অমূল্য উকিলের মতো বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বরা। নৌকায় ফিরতে ফিরতে রাতও হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সেই জ্যোৎস্না ধোয়া রাতে সুভাষের কাছে একটা গান গাইবার আবদার করেছিলেন হেমন্ত কুমার। জলদগম্ভীর গলায় সুভাষ ধরেছিলেন, "দূরে হের চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত গঙ্গা, ধায় মত্ত হরষে সাগরে..."
আগেই বলেছি, হেমন্ত কুমারের মধ্যে একটা সংগ্রামী চেতনা ছোটোবেলা থেকেই ছিল। সেকারণে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আর চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি। শ্রমজীবীদের জন্য একটি অবৈতনিক স্কুল শুরু করেছিলেন। স্কুলটি মূলত সন্ধ্যেবেলায় শুরু হত। আর চলত বেশ রাত পর্যন্ত। এই স্কুলে এসে সুভাষ চন্দ্র বসুও মাঝেমধ্যে পড়িয়ে যেতেন। সেকথা হয়ত স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কখনই লেখা হয়নি। নদীয়ার তৎকালীন জেলা শাসক এই মহানুভব উদ্যোগকে যথেষ্ট প্রশংসা এবং সাহায্য় করেছিলেন।
A book on Hemanta Kumar Sarkar, childhood friend of Subhas Chandra Bose pic.twitter.com/5u6PnoTJUn
— Saswati Sarkar (@sarkar_swati) August 18, 2018
আপনারা সকলেই জানেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। কিন্তু, ইংরাজিতে নম্বর সামান্য কম থাকার কারণে তিনি কোনও স্থান অর্জন করতে পারেননি। প্রসঙ্গত, সুভাষের সঙ্গেই ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন হেমন্তকুমার সরকার।
Ironic that we have a govt in independent India that is threatened by its citizens saying Azadi. Netaji Subhash Chandra Bose’s army, the Azad Hind Fauj had a motto that is inspiring and relevant to the day:
— Sitaram Yechury (@SitaramYechury) January 23, 2020
Ittehad, Etmad aur Qurbani
(Unity, Faith and Sacrifice) pic.twitter.com/pUSNruc5Hk
শেষে এই হেমন্ত কুমার সরকারের জীবনী সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। ১৮৯৭ সালে নদীয়া জেলার বাগঞ্চরা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। তিনি বাংলার একজন বিশিষ্ট লেখক, ভাষাবিদ এবং জীবনীকার ছিলেন। মুজাফ্ফর আহমেদ ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে বাংলায় শ্রম স্বরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি ১৯৪৭ সালে বাংলার বিভাজন এবং বাঙালি হিন্দু স্বদেশ গঠন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। জীবনের শেষ দিনগুলো কৃষ্ণনগরেই কাটিয়েছিলেন হেমন্ত কুমার। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তিনিই প্রথম আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তিনি আবারও জনসমক্ষে ফিরে আসবেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যুর খবর একেবারেই ভুল। তিনি লিখিতভাবে তাঁর এই আশার প্রমাণও রেখে গিয়েছিলেন।