বাংলার একেবারে লাগোয়া রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকেই ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে দায়িত্ব দিল বিজেপি। রাজনীতিতে প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনেই একটি বড় কারণ থাকে। এমনকী কেউ কারও সঙ্গে করমর্দন বা হেসে কথা বললেও, তার পিছনে রাজনৈতিক সূক্ষ্ম স্ট্র্যাটেজি থাকেই। আর এটা একেবারে বিধানসভা নির্বাচন। তাই বিপ্লব দেবকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে কো ইনচার্জ করার পিছনেও যে বিরাট একটি প্ল্যান রয়েছে,তা বোঝাই যাচ্ছে।
ত্রিপুরায় এই সেদিনও বিজেপির নাম ও নিশান ছিল না
দিল্লির কার্যকর্তা থেকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, তারপর লোকসভায় বিজেপির সদস্য। একটি মানুষের রাজনীতি ও সাংগঠনিক দক্ষতা কতটা ভাল, এই প্রোফাইলেই তার ইঙ্গিত মেলে। ভোট রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা ও সংগঠন সামলানোর মিশেল। ত্রিপুরার রাজনীতিতে বিপ্লব দেবের এন্ট্রি ২০১৫ সালে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যে বলা যায় বিজেপির টার্নিং পয়েন্ট। ত্রিপুরার মাটিতে যেদিন পা দিলেন বিপ্লব দেব, তখন রাজ্যটিতে বিজেপির নাম-নিশানও ছিল না। এমনকী একজন মণ্ডল অধ্যক্ষও খুঁজে পাওয়া যেত না।
এরপর শুরু হল সদস্য সংগ্রহ। মিসড কল ক্যাম্পেনে ১.৫ লক্ষ সদস্য যুক্ত হল ত্রিপুরা বিজেপিতে। বলা যায়, বিপ্লব দেব দাগ কাটা শুরু করলেন। শুধু বিজেপি কর্মী সমর্থকদের সঙ্গেই নয়, সিপিএম এর নেতা ও পরিবারের সঙ্গেও নিজে গিয়ে দেখা করতে শুরু করলেন। যাকে বলা যায়, একেবারে মাঠে নেমে রাজনীতি। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা। ত্রিপুরার মানুষের মন বোঝার চেষ্টা।
মাত্র দু বছরেই ত্রিপুরায় পরিবর্তন
২০১৬ সালে ত্রিপুরায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন বিপ্লব। তারপর মাত্র দু বছরেই ত্রিপুরায় পরিবর্তন। ৬০ আসনের বিধানসভার ত্রিপুরায় ৩৬টি আসন নিয়ে জিতল বিজেপি। ২৫ বছরের বাম শাসনের অবসান। বিপ্লব দেব হলে ত্রিপুরার প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী। যেন, এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
এবার আসা যাক ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে। সেখানেও বিপ্লব দেব সফল। ত্রিপুরা পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রে ৮ লক্ষ ৮১ হাজারের বেশি ভোট নিয়ে জিতলেন। কংগ্রেসের আশিস কুমার সাহাকে হারালে ৬ লক্ষ ১১ হাজার ৫৭৮ ভোটে। বিরাট মার্জিন। ওই কেন্দ্রের অতীতে কেউ এত ভোটের মার্জিনে জেতেননি।
হরিয়ানাও চ্যালেঞ্জ ছিল
এরপরই দল তাঁকে আরও বড় দায়িত্ব দিয়ে দিল। ২০২৪ এ হরিয়ানার বিধানসভা ভোটে কো-ইনচার্জ। এটাও কিন্তু সহজ একটা ভোট ছিল না। লোকসভার খারাপ ফলের পর বিজেপির ভাবমূর্তি ফেরানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। হরিয়ানায় তখন প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া।তাই এই নির্বাচনকে বলা হচ্ছিল লিটমাস টেস্ট। ধর্মেন্দ্র প্রধানের নেতৃত্বে বিপ্লব দেব এমন কৌশল সাজালেন যে, টানা তৃতীয়বার সরকার গড়ল বিজেপি। ফলে আবারও দলের সাংগঠনিক শক্তির উপর আস্থা ফিরল।
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার অনেক মিল
বিপ্লব দেবের এই বহুমুখী দক্ষতাকেই পশ্চিমবঙ্গে কাজে লাগাতে চাইছেন অমিত শাহ। একই সঙ্গে প্লাস পয়েন্ট হল, বিপ্লব দেব বাংলাও একেবারেই সরগর। ফলে হিন্দিভাষী তকমা জুটবে না। আসলে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেখছে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার অনেক মিল রয়েছে। বিজেপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতার বক্তব্য, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামফ্রন্টকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু আজ তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসও সেই পুরনো শাসকের মতো হয়ে গিয়েছে, যাদের একসময় তিনি বিরোধিতা করতেন। এমন গাঁটমারা রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়তে বিজেপির দরকার বিপ্লব দেবের মতো নেতা, যিনি নিজে হাতে বামেদের ঘাঁটি ভেঙেছেন।
বিপ্লব দেবই আসলে সেই বার্তা বহন করছেন, যা বিজেপি বাংলায় দিতে চাইছে, ধৈর্য, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আর সংগঠনের শক্তি থাকলেই গভীরে শেকড় গেড়ে বসা রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করা যায়। এই বাজি শেষ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে কাজে আসবে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে।