
রথযাত্রা আগামী ২৭ জুলাই। প্রায় এসেই পড়েছে। পুরীতে এই সময়ে তিল ধারণেরও জায়গা নেই। ট্রেনের টিকিট পাওয়াও মুস্কিল। পুরীর মতো অবস্থা দিঘাতেও। প্রথমবার জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা দেখতে সেখানেও ভিড় জমাচ্ছেন বহু মানুষ। ট্রেন, বাসে টিকিট নেই। হোটেলের ভাড়াও আকাশছোঁয়া। এদিকে রথের দিন জগন্নাথের জয়ধ্বনিতে মাততে চাইছেন আপনি, কিন্তু দিঘা-পুরীতে যাওয়ার উচ্ছে থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না। চিন্তা করবেন না। আমাদের রাজ্যেও কয়েকটি স্থানের রথযাত্রা বেশ প্রসিদ্ধ। এবছরের রথযাত্রার সাক্ষী হতে যেতে পারেন এই স্থানগুলিতে।
মায়াপুর
নদিয়া জেলার মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের রথযাত্রা অন্যতম বিখ্যাত। এখানেও জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা রথে চড়েন। মায়াপুর এবং রাজাপুর পাশাপাশি দুটি গ্রাম। রাজাপুরের বেশিরভাগ বাসিন্দা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। প্রায় পাঁচশো বছর আগে এক পুরোহিত স্বপ্নে পান, রাজাপুর থেকে মায়াপুরে যাবেন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। প্রথা মেনেই প্রতিবছর রথযাত্রা উত্সব পালিত হয় মায়াপুরে। এই প্রথা অনুসারে প্রতিবছর মায়াপুর ও রাজাপুর গ্রামে রথ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পরে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ কৃষ্ণ কনসায়নেস (ইসকন) এই রথযাত্রার দায়িত্ব নেন ।
মাহেশের রথযাত্রা
পুরীর মতো না হলেও প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যের বিচারে বাংলার মধ্যে হুগলির মাহেশের রথের স্থান সম্ভবত সর্বাগ্রে। রথযাত্রার দিনে প্রাচীন এই জনপদে রথ টানতে ভিড় করেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। রাস্তায় তো বটেই, দু’পাশের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায়, ছাদে, দোকানেও তখন উপচে পড়া ভিড়। সকলেই চান রথে আসীন জগন্নাথের এক বার দর্শন পেতে। শোনা যায়, ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় ধ্রুবনন্দ ব্রহ্মচারী উত্সবের সূচনা করেছিলেন। তা প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো। কথিত আছে, মাহেশের রথের মাথায় নাকি একটি নীলকন্ঠ পাখি এসে বসে।
গুপ্তিপাড়া
রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন রথযাত্রার মধ্যে অন্যতম হুগলির গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। জানা যায়, ১৭৪০ সালে এই রথ উৎসব শুরু করেন মধুসুদানন্দ মতান্তরে পিতাম্বরানন্দ। গুপ্তিপাড়ার রথ বৃন্দাবন জিউ রথ। এই বছর রথ যাত্রার ২৮৫ বছর। রথযাত্রা ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে ঐতিহ্যপূর্ণ বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের পাশে বছরভর এই রথ টিনের খাঁচায় ভরা থাকে। চারতলা এই রথের উচ্চতা প্রায় ৩৬ ফুট, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩৪ ফুট। আগে রথে ছিল বারোটা চূড়া, বর্তমানে নয়টি চূড়া। বৃন্দাবন মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা রথে চড়ে পাড়ি দেন এক কিলোমিটার দূরে মাসির বাড়ি গোসাঁইগঞ্জ-বড়বাজার এলাকায়। গুপ্তিপাড়া রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে মন্দির চত্বরে।
আমোদপুর
বর্ধমানের মেমারি অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম আমোদপুর বা আমাদপুর। গ্রাম ছোট্ট হলেও, এই গ্রামে রথযাত্রা পালন করা হয় ধুমধাম করে। গ্রামের জমিদার পরিবারের দেবতা হলেন রাধামাধব। সেই রাধামাধবকে নিয়ে হয় রথযাত্রা। গ্রামেরই প্রাচীন মন্দিরে পুজো হয় তাঁর। রথের দিন সকালে তাঁকে প্রথমে দুর্গাবাড়ি (মা দুর্গার মন্দির), পরে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়।এই রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার পাশে রাধামাধবের মূর্তিও থাকে। আমাদপুরের রথযাত্রার একটি রাজকিয় ব্যাপার রয়েছে। স্থানীয় প্রথা অনুসারে, রথের চাকা থেকে মাটি নেওয়া হয় যা পরবর্তীকালে দুর্গা প্রতিমা গড়ার সময় কাজে লাগানো হয়।
রাজবলহাট
হুগলির রাজবলহাট খুবই বিখ্যাত জায়গা। তবে এই জায়গার নাম তার তাঁতের কাপড়ের জন্য। এছাড়াও এখানকার রথযাত্রা খুব বিখ্যাত। আমাদপুরের মতোই এখানেও রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা থাকেন না। এই রথে থাকেন এলাকার বিখ্যাত মন্দিরের পূজ্য দেবতা রাধাকৃষ্ণ।
মহিষাদল
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথযাত্রা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো এবং বিখ্যাত রথযাত্রাগুলির একটি। এটি প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। ১৭৭৬ সালে এখানকার জমিদার আনন্দলালের স্ত্রী জানকী এই রথযাত্রার সূচনা করেছিলেন।
কলকাতার ইস্কনের রথযাত্রা
বর্তমানে কলকাতার সবচেয়ে নামী রথযাত্রা বলা যেতে পারে এটিকে। ১৯৭২ সাল থেকে এই রথযাত্রার শুরু। কলকাতার অ্যালবার্ট রোডে ইসকনের রাধাগোবিন্দ মন্দির থেকে এই রথের শোভাযাত্রা শুরু হয় প্রতি বছর। তারপর ক্যামাক স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গী, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, মহাত্মা গাঁধী রোড হয়ে তা শেষ হয় ১২ মহাত্মা গাঁধী রোডে, মল্লিকদের ঠাকুরবাড়িতে। এই রথের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, যে-কোনও ধর্মের, যে-কোনও সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে অংশগ্রহণ করতে পারেন।