মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার বিলে সম্মতি নেই রাষ্ট্রপতিররাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বড়সড় বদল আর আনা হল না। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত দুই সংশোধনী বিলে শেষপর্যন্ত সম্মতি দিলেন না রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বড়সড় বদল আনতে পারত যে দুই সংশোধনী বিল, সেগুলিতে সম্মতি দিলেন না রাষ্ট্রপতি। রাজ্য-সহায়তাপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির রাজ্যপাল তথা আচার্যের ক্ষমতা বদলের প্রস্তাব ছিল সংশ্লিষ্ট বিলগুলিতে। ফলে আপাতত রাজ্য-সহায়তাপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চ্যান্সেলর পদে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণের পরিধি আরও বাড়াতে পদক্ষেপ করেছিল রাজ্য সরকার। বিধানসভায় বিল পাস করে রাজ্যপালকে সরিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিল নবান্ন। কিন্তু রাজ্য-সহায়তাপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী বিলে সম্মতি দিলেন না রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। আচার্য পদে পরিবর্তনের যে প্রস্তাব রাজ্য সরকার পাঠিয়েছিল, তা কার্যত খারিজ হয়ে গেল। রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আচার্য হিসেবে রাজ্যপালের ভূমিকাই বহাল থাকছে। ফলে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ নিয়ে বড় পরিবর্তনের উদ্যোগে আপাতত স্থগিত হয়ে গেল।
উল্লেখ্য, গত ২০ এপ্রিল ২০২৪-এ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধনী) বিল, ২০২২ রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ওই বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল, রাজ্যের সহায়তাপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে আচার্য হিসাবে রাজ্যপালের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করবেন। রাজ্য সরকার যুক্তি দিয়েছিল, এতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি আসবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সরকারের ভূমিকা আরও কার্যকর হবে। তবে কেন্দ্রীয় স্তরে বিলটি খতিয়ে দেখার পর রাষ্ট্রপতি দু’টি সংশোধনী বিলে সম্মতি দেননি। এর ফলে বর্তমান ব্যবস্থাই বহাল থাকছে এবং রাজ্যের সহায়তাপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হিসাবে রাজ্যপালই দায়িত্বে থাকবেন।
রাজ্য ও রাজভবনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা এবং উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে যে টানাপড়েন চলছিল, এর ফলে সেই বিতর্ক আরও এক ধাপ এগোল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক ও শিক্ষামহলের একাংশ। প্রসঙ্গত, রাজভবন ও নবান্নর মধ্যে সংঘাত নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে উপাচার্য নিয়োগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য সরকার ও রাজভবনের মধ্যে তীব্র দড়ি টানাটানি চলছে। এই আবহেই আচার্য হিসেবে রাজ্যপালের ক্ষমতা 'খর্ব' করতে সক্রিয় হয়েছিল রাজ্য সরকার। ২০২২ সালে বিধানসভায় পাস করানো হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধনী) বিল’। পাশাপাশি, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও আচার্য বা 'আমির-ই-জামিয়া' পদে রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে বসানোর জন্য পাশ হয় আলাদা বিল। সাংবিধানিক নিয়ম মেনে বিলগুলি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন। নবান্নের যুক্তি ছিল, নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার রাশ থাকা উচিত। শিক্ষামহলের একাংশের মতে, উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বারবার রাজভবনের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা আসছিল। সেই ‘অচলাবস্থা’ কাটাতে এবং উচ্চশিক্ষার প্রসারে গতি আনতেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে আচার্য বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিরোধীরা, বিশেষ করে বিজেপি, প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছিল যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়াতেই এই বিল আনা হয়েছে। তাদের দাবি ছিল, এতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন ক্ষুণ্ণ হবে। রাষ্ট্রপতির এই অসম্মতির পেছনে বড় কারণ হিসেবে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ আইনি জটিলতার কথা তুলে ধরছেন। বর্তমানে আইনের কাঠামো অনুযায়ী, রাজ্যপাল পদাধিকার বলে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য। এই প্রথা ভেঙে মুখ্যমন্ত্রীকে সেই পদে বসানো সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। রাষ্ট্রপতির সম্মতি না মেলায় এটা স্পষ্ট যে, এই সংশোধনীগুলি সাংবিধানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। ফলে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রশাসনে কোনও বড় বদল আসছে না, বরং স্থিতাবস্থাই বজায় থাকছে।