

বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগে ভোটার তালিকার বিশেষ ও নিবিড় সংশোধন বা SIR প্রক্রিয়া শুরু হতেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার তালিকায় নাম থাকার অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। এমনকি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালানোর চেষ্টার অভিযোগে একাধিক এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক।
আর এই সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে শিয়ালদহ স্টেশনের একটি ভিডিও। যেখানে স্টেশনের ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনে প্রচন্ড ভিড়ে কিছু যাত্রীকে হুড়োহুড়ি করতে এবং বাচ্চা-সহ কয়েকজনকে মেঝেতে পড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, SIR প্রক্রিয়া শুরু হতেই শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালাচ্ছে অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীরা।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “SIR চালু হওয়ার দিন থেকেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে এতটাই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব শিয়ালদহ স্টেশনে দেখা গেছে।” পাশাপাশি, ভিডিওর ফ্রেমের উপর লেখা হয়েছে, “SIR শুরু হতেই শিয়ালদহ স্টেশনের চিত্র, খেলা শুরু হয়ে গেছে।” (সব বানান অপরিবর্তিত)

ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ভিডিও-র সঙ্গে ‘SIR’এর কোনও সম্পর্ক নেই। বরং সেটি নির্বাচন কমিশনের তরফে পশ্চিমবঙ্গে SIR ঘোষণার পূর্বে গত ১৫ অক্টোবর শিয়ালদহ স্টেশনে লালগোলা-শিয়ালদহ প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীদের বাইরে বেরিয়ে আসার দৃশ্য।
সত্য উন্মোচন হলো যেভাবে
ভাইরাল ভিডিও এবং দাবির সত্যতা জানতে সেটি থেকে একাধিক কিফ্রেম সংগ্রহ করে সেগুলি গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ২০২৫ সালের ১৫ অক্টোবর তৌফিক খান নামক একটি ফেসবুক প্রোফাইলে এই একই ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “লালগোলা শিয়ালদা মেমো ট্রেন ঢুকেছে তার পরে প্যাসেঞ্জার খালি হয়নি আর একটা ট্রেন দিয়ে দিয়েছে দিয়ে সেম লাইনে অবস্থা দেখুন দুটো বাচ্চা ভেতরে পড়ে গেছে কি অবস্থা হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।”

এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে ভিডিওটির সঙ্গে SIR-এই প্রক্রিয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ, নির্বাচন কমিশন গত ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য ১২টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোটার তালিকার বিশেষ ও নিবিড় সংশোধনের কথা ঘোষণা করেছিল। অন্যদিকে ভাইরাল ভিডিওটি তার প্রায় ১২ দিন আগে থেকেই তৌফিক খান নামক ওই ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইলে রয়েছে।
পাশাপাশি, তৌফিক খানের ফেসবুক প্রোফাইলটি পর্যবেক্ষণ করলে গত ৫ নভেম্বর ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে তার একটি ভিডিও বিবৃতি পাওয়া যায়। সেখানে তিনি তার রেকর্ড করা ভিডিও নিয়ে মিথ্যে প্রচার চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, গত ১৫ অক্টোবর তিনি লালগোলা থেকে শিয়ালদহ এসেছিলেন। নামার পর তিনি দেখেন, ওই একই লাইনে অন্য একটি ট্রেনের ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। আর এর ফলে যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে ট্রেন থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে কয়েকজন বাচ্চা প্লাটফর্মের উপর পড়ে যায়। তখন তাদের মা তাদেরকে আগলে রাখার চেষ্টা করছিল। সেই মূহুর্তে সেখানে উপস্থিত তৌফিক পুরো ঘটনাটি মোবাইলে রেকর্ড করে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেছিলেন।

তৌফিকের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে, আমরা প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির সময়ের সঙ্গে লালগোলা-শিয়ালদহ প্যাসেঞ্জার ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছনোর সময়ের তুলনা করে দেখি। দেখা যায়, ভিডিওটি যখন রেকর্ড করা হয়েছিল সেই সময় প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি অনুযায়ী সময় হয়েছিল ১৬টা ১৯ মিনিট অর্থাৎ বিকাল ৪টে ১৯ মিনিট। অন্যদিকে, আমরা লালগোলা-শিয়ালদহ প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সময়সূচি পর্যবেক্ষণ করার সময় লক্ষ্য করি, লালগোলা থেকে সকাল ১১টা ১৮ মিনিটে যে ট্রেনটি ছাড়ে, সেটি বিকাল ৪টে নাগাদ শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছয়। তবে অনেক সময় ট্রেন কিছু সময় দেরিতেও ঢোকে।
অন্যদিকে, শিয়ালদহ-লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সময়সূচি পর্যবেক্ষণ করার সময় লক্ষ্য করা যায় যে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বিকাল ৪টে ১০ মিনিটে একটি ট্রেন লালগোলার জন্য ছাড়া হয়। যা রাত ৮টা ৩০ মিনিটে লালগোলা স্টেশনে পৌঁছায়। আর এই উভয় ট্রেনের শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছনো এবং শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ছাড়ার সময়ের সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওতে প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির সময়ের পার্থক্য খুবই কম। যে কোনও ট্রেন সামান্য লেট করলে যেটা হওয়া স্বাভাবিক। এর থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তৌফিকের দাবি সঠিক।

সবমিলিয়ে প্রমাণিত যে, SIR শুরু হতেই শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পালানোর দৃশ্য দাবি করে ছড়ানো হচ্ছে পুরনো অসম্পর্কিত ভিডিও।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, SIR প্রক্রিয়া শুরু হতেই শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালাচ্ছে অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীরা।
ভাইরাল ভিডিও-র সঙ্গে ‘SIR’এর কোনও সম্পর্ক নেই। বরং সেটি গত ১৫ অক্টোবর শিয়ালদহ স্টেশনে লালগোলা-শিয়ালদহ প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীদের বাইরে বেরিয়ে আসার দৃশ্য।