
এখনও লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তার আগেই রাজ্যের ৪২টি আসনের জন্য সম্পূর্ণ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে শাসকদল তৃণমূল। অন্যদিকে, প্রথম দফায় বাংলায় নিজেদের ২০ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিজেপি। আর তারপর থেকেই সরগরম হয়ে উঠেছে বঙ্গ রাজনীতি।
সেই প্রচারের আঁচ লক্ষ্য় করা গেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। তারই মধ্য়ে সম্প্রতি তৃণমূল সমর্থকদের তরফে ভাইরাল করা হচ্ছে বিশেষ একটি পোস্ট। যেখানে দাবি করা হয়েছে, তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীর পরিবর্তে সদ্য গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়া কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে টিকিট দিতে চলেছে বিজেপি। আর নিজের জেতা আসনে টিকিট না পেয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে ‘নর্দমা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন দিব্যেন্দু।
উদাহরণস্বরূপ, নিপ্নন শান্তিকারী নামক এক ফেসবুক ব্যবহারকারী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও দিব্যেন্দু অধিকারীর সম্মিলিত একটি গ্রাফিক ছবি পোস্ট করেছেন। যে ছবিতে লেখা আছে, “তমলুকে দলের টিকিট না মেলায় বিস্ফোরক দিব্যেন্দু, অভিজিৎ-কে 'নর্দমা'র সঙ্গে তুলনা! দীর্ঘদিন পর লোকসভা নির্বাচনের মুখে এসে মুখ খুলেই বিস্ফোরক তমলুকের বিদায়ী সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী। বিজেপির তরফ থেকে টিকিট না পাওয়ায় দলের প্রতি ক্ষোভ উগরে দেন, সঙ্গে 'পদ্মপ্রার্থী' অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে তীব্র কটাক্ষ করেন।”
এই একই ছবি পোস্ট করে সুব্রত সিনহা নামক অপর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ক্যাপশনে লিখেছেন, “বেচারী শুভেন্দু। এগোলেও বাঁশ, পিছোলেও বাঁশ। কোন পথে যায় বেচারা। অভিজিৎ জিতে গেলে বিজেপির বাংলার মুখ অভিজিৎ হয়ে যাবে আর হেরে গেলে শুভেন্দুর কর্তৃত্ব নষ্ট হবে। আমার কিন্তু হেব্বি মজা লাগছে।”
একই ছবি পোস্ট করে মৃদুল ভট্টাচার্য নামক আর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “গোয়াল ঘরে গুঁতোগুঁতি।”
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে ভাইরাল পোস্টটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে এহেন কোনও মন্তব্য করেননি।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
প্রথমত, এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ২০টি আসনের জন্য প্রার্থী তালিকার নাম প্রকাশ করেছে বিজেপি। যার মধ্যে আসানসোলের প্রার্থী নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু সেই তালিকায় নেই তমলুক আসনটির নাম। সুতরাং তমলুক থেকে দিব্যেন্দু অধিকারীর পরিবর্তে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রার্থী করার বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে জল্পনা থাকলেও তাতে দলীয় সিলমোহর পড়েনি। ফলে, তমলুকে দিব্যেন্দুর টিকিট না মেলার বিষয়টিও এখনও চূড়ান্ত নয়। জল্পনা সত্যি হবে কি না, তা সময়ই বলবে।
ভাইরাল পোস্টে দাবি করা হয়েছে, টিকিট না পেয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে 'নর্দমা'র সঙ্গে তুলনা করেছেন তমলুকের সাংসদ। বিরোধী দলনেতার সহোদর তথা সাংসদ দিব্যেন্দু যদি এহেন বিস্ফোরক মন্তব্য করে থাকেন, তবে তা সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশ পাবে। কিন্তু আমাদের কিওয়ার্ড সার্চে এমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য বা প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি যা থেকে আন্দাজ করা যায় অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে নিয়ে এহেন মন্তব্য করেছেন দিব্যেন্দু অধিকারী।
উল্টোদিকে, গতকাল অধিকারীদের বাসভবন শান্তিকুঞ্জে যান অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে শিশির ও দিব্যেন্দু অধিকারীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি। সেই সৌজন্য সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের করা প্রশ্নের উত্তরে, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্যই করেন তমলুকের বিদায়ী সাংসদ।
এরপর ভাইরাল পোস্টের বিষয়ে সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীর মতামত জানতে আমরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের জানান, “অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। আমি তাঁর সম্পর্কে এমন কোনও মন্তব্য করা তো দূরের কথা এমন কোনও কথা ভাবতেও পারি না। আমাকে বদনাম করার জন্য কিছু মানুষ আমার বিরুদ্ধে এহেন মিথ্যা প্রচার করছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে আজই আদালত ও সাইবার ক্রাইম দপ্তরে অভিযোগ জানাবো।”
গুজবের উৎস কোথা থেকে?
এই সংক্রান্ত নানা কিওয়ার্ড সার্চ করার সময়ই আমরা আনন্দবাজার অনলাইনের একটি খবরের স্ক্রিনশট খুঁজে পাই। আমরা লক্ষ্য করি, সেই প্রতিবেদনের শিরোনামের সঙ্গে ভাইরাল পোস্টের দাবির হুবহু মিল রয়েছে। এর পরেই আমরা খোঁজার চেষ্টা করি আনন্দবাজার অনলাইনে আদৌ এমন কোনও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে কি না। কিন্তু, এমন কোনও খবর আমাদের নজরে আসেনি।
পক্ষান্তরে, আনন্দবাজার অনলাইনে আমরা একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই যেখানে তারা ভাইরাল হওয়া এই স্ক্রিনশট নিয়ে একটি খবর করেছে এবং এটিকে ভুয়ো হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। এই প্রতিবেদনকে ভুয়ো সাব্যস্ত করতে আনন্দবাজার নিজেদের আসল প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটের সঙ্গে নকল প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটের তুলনা করে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, কেন ভাইরাল স্ক্রিনশট সঠিক নয়। নীচে আনন্দবাজারে প্রকাশিত আসল খবরের স্ক্রিনশট ও জাল খবরের স্ক্রিনশটের তুলনা দেখা যাবে।
এই বিষয়ে আরও জানতে আমরা আনন্দবাজার অনলাইনের একাধিক প্রতিনিধির সঙ্গেও কথা বলি। তাঁরাও আমাদের নিশ্চিত করেন যে এমন কোনও খবর সেখানে প্রকাশিত হয়নি।
এর থেকেই প্রমাণ হয় যে আনন্দবাজারের একটি ভুয়ো খবরের স্ক্রিনশটকে ভিত্তি করে দিব্যেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যে প্রচার করা হচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘নর্দমা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন তমলুকের বিদায়ী সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী।
দিব্যেন্দু অধিকারী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘নর্দামা’র সঙ্গে তুলনা করেননি। ভাইরাল সব পোস্টই ভুয়ো।