গত ৪ আগস্ট কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন (AIBEA)-কে উদ্ধৃত করে এক্স-এ একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের নির্দেশে আদানি গোষ্ঠীর ১০টি কোম্পানির মোট ৬১,৮৩২ কোটি টাকার বকেয়া ঋণের মধ্যে ৪৫ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দিয়েছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি।
আর এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সংক্রান্ত একটি পোস্ট বেশ ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকায় সাধারণ মানুষের থেকে জরিমানা বাবদ ৮৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করে মোদী সরকারের নির্দেশে সেই টাকা থেকেই আদানি গোষ্ঠীর প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ মাফ করে দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “নূন্যতম ব্যালেন্স না থাকায় 85 হাজার কোটি আদায় ব্যাংকের। আদানির ঋণ মাফ 46 হাজার কোটি টাকা, গরিবের সামান্য সঞ্চয়ের টাকা কেড়ে ধনীদের দান।” (সব বানান অপরিবর্তিত।) সরাসরি উল্লেখ না করা হলেও এই পোস্ট ও পোস্টের কমেন্ট সেকশনেও অন্যান্য ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তরফে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলেই অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকায় সাধারণ মানুষের থেকে জরিমানা বাবদ ৮৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল দাবিটি অর্ধসত্য ও বিভ্রান্তিকর। মোদী সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না রাখার কারণে ৮৫ হাজার কোটি নয় বরং প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
প্রথমত আমরা কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে সম্প্রতি আদানি গোষ্টীর প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য খুঁজে বার করি। তখন আমরা গত ৪ সেপ্টেম্বর দ্য হিন্দুতে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “টাকা দিতে না পারায় দেউলিয়া আদালতে থাকা ১০টি সংস্থার ৬১,৮৩২ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ মাত্র ১৫,৯৭৭ কোটিতে রফা করেছে ঋণদাতা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। অর্থাৎ মকুব করেছে ৪৫ হাজার ৮৫৫ কোটি বকেয়া টাকা। আর এই ১০টি সংস্থাকেই কিনেছিল গৌতম আদানির গোষ্ঠী।” এর থেকে স্পষ্ট হয় যে ভাইরাল পোস্টে আদানি গোষ্ঠীর ঋণ মকুবের দাবিটি যাথাযথ।
এরপর আমরা কেন্দ্রের মোদী সরকারের আমলে বিগত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না রাখার কারণে ৮৫ হাজার কোটি জরিমানা বাবদ আদায় করেছে কিনা সেই সংক্রান্ত তথ্য জানতে পুনরায় একাধিক কিওয়ার্ড সার্চ করি। কিন্তু আমাদের সার্চে এমন কোনও তথ্য পাইনি যা থেকে এর সত্যতা প্রমাণ হয়। তবে কিওয়ার্ড সার্চ করার সময় ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই আমরা দ্য হিন্দু বিজনেস লাইনে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ২০১৯-২০ অর্থ বর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষ পর্যন্ত অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না রাখার কারণে সাধারণ মানুষের থেকে ৮,৫০০ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
এরপর আমরা পুনরায় একাধিক কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মোদী সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না রাখার কারণে মোট কত টাকা জরিমানা আদায় করেছে তা জানার চেষ্টা করি। তখন আমরা ভারতীয় সংসদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত দুটি আলাদা নোটিশ দেখতে পাই। যার মধ্যে প্রথমটি ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত। সেই সময় সংসদে একটি প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী শ্রী শিব প্রতাপ শুক্লা জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই চার বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকার কারণে মোট প্রায় ৬,২৪৬ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করে।
ভারতীয় সংসদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত দ্বিতীয় নোটিশটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই। এবারও সংসদে একটি প্রশ্নের উত্তরে বর্তমান কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী শ্রী পঙ্কজ চৌধুরী জানান, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকার কারণে সাধারণ মানুষের থেকে মোট প্রায় ৮,৪৯৫ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করে। অর্থাৎ মোদী সরকারের আমলে শেষ ৯ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকার কারণে মোট প্রায় ১৪,৭৪১ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এখানে উল্লেখ্য কেন্দ্রে মোদী সরকারের প্রথম বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের জরিমানা সংক্রান্ত কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ ভারতী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকার জন্য জরিমানা নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। যেটি পরের অর্থবর্ষ অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষ থেকে কার্যকর হয়।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে মোদী সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকার কারণে সাধারণ মানুষের থেকে ৮৫ হাজার কোটি নয় বরং প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকার জন্য ৮৫ হাজার কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
৮৫ হাজার কোটি নয় বরং কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি।