যে কজন প্রথিতযশা ব্যক্তিদের নিয়ে বাঙালি সমাজ গর্ব করে, তাঁদের মধ্যে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নাম অন্যতম। বিজ্ঞানের জগতে তাঁর অবদান এতটাই ছিল যে শুধু দেশে নয়, তাঁর গবেষণা নানা সময় বিদেশেও আলোচনার বিষয় হয়ে থেকেছে। সেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে এ বার একটি দাবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভীষণভাবে ভাইরাল হয়েছে।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ছবি-সহ একটি প্রতিবেদনের অংশ প্রকাশ করে দাবি করা হচ্ছে, ব্রিটেনের ৫০ ইউরোর নোটে নাকি এবার জগদীশ চন্দ্র বসুর ছবি যুক্ত করা হবে। সেই সঙ্গে একটি সংবাদ পত্রের প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে যেখানে শিরোনামে লেখা, "গণভোটে ব্রিটেনের জনগণের রায়। ব্রিটেনের ৫০ পাউন্ড নোটে থাকছে জগদীশচন্দ্র বসুর ছবি।" সেই প্রতিবেদনের উপর বিজ্ঞানীর একটি সাদা-কালো ছবিও দেখা গিয়েছে।
প্রতিবেদনের ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে একাধিক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, "ইউকে ব্রিটেনে 50 পাউন্ড মুদ্রার নোটে যুক্ত হচ্ছে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সনাতনী সম্প্রদায়ের অহংকার স্যার, জগদীশ চন্দ্র বসুর ছবি। ~স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একাধারে পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। অবিভক্ত ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে ১৮৩৮ সালের ৩০ নভেম্বর এই বিশ্ববরেণ্য সনাতনী প্রাণপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন।
জন্মসূত্রে বাঙালি হিন্দু এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। জয় শ্রীরাম।"
ভাইরাল এই ফেসবুক পোস্টের আর্কাইভ এখানে এখানে ও এখানে দেখা যাবে।
ইন্ডিয়া-টুডের অ্যান্টি-ফেক নিউজ ওয়ার রুম (আফয়া) অনুসন্ধান করে দেখেছে যে সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে যাওয়া এই দাবি বিভ্রান্তিকর, এবং সত্যি নয়। তবে এ কথা সত্যি যে ব্রিটেনের ৫০ পাউন্ডের নোটে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ছবি ছাপা হতে পারে, বছর তিনেক আগে এমন একটা সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠেনি। তাঁর জায়গায় অন্য এক বিজ্ঞানীর ছবি মুদ্রিত হয়।
আফয়া তদন্ত
ভাইরাল দাবির সত্যতা খুঁজতে সবার প্রথম আমরা ভাইরাল হওয়া প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে পড়া শুরু করি। পড়তে গিয়ে যে বিষয়টি আমাদের নজরে ঠেকে তা হল- প্রতিবেদনের ভিতরে এমন কোথাও লেখা নেই যে ৫০ পাউন্ডের নোটে জগদীশচন্দ্র বসুর ছবি থাকবে। বরং লেখা ছিল- বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের পাশাপাশি জগদীশচন্দ্র বসুর নামেও মনোনয়ন হয়েছে। এবং তাঁর ছবি থাকতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা লেখা ছিল সেখানে।
বিষয়টি সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে আমরা কি-ওয়ার্ড সার্চ করি। তখন বছর তিনেক আগের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি প্রতিবেদন এই বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, ৫০ টাকার নোটে ছবি ছাপার জন্য আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পাশাপাশি আরও কয়েকশো বিজ্ঞানীর নামে মনোনয়ন জমা পড়েছিল। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে এই প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। সুতরাং এ কথা অনুমান করা যায় যে ওই সময় নাগাদই মনোনয়নও জমা পড়েছিল।
কিন্তু নোটে কি বাঙালি বিজ্ঞানীর ছবি ছাপা হয়েছিল? সেই উত্তর আমাদের দিয়ে দেয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের আরেকটি প্রতিবেদন। যার শিরোনামেই পরিষ্কার লেখা হয়, জগদীশচন্দ্র বসু নয়, ৫০ ইউরোর নোটে থাকছে বিজ্ঞানী অ্যালান টিউরিংয়ের ছবি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ পাওয়া সেই প্রতিবেদনেই সাফ হয়ে যায় যে, জগদীশচন্দ্র বসুর নাম মনোনীত হলেও নোট তাঁর ছবি-সহ ছাপা হয়নি।
এই বিষয়ে আরও নিশ্চিত হতে আমরা ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের ওয়েবসাইটেও খুঁজে দেখি। সেখানে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই প্রকাশ পাওয়া এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে অ্যালান টিউরিং নামের বিখ্যাত গণিতজ্ঞের ছবি ৪০ ইউরোর নোটে থাকবে। এবং ২০২১ সালের শেষভাগে এসে সেই নোট বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে।
কে এই অ্যালান টিউরিং?
বিখ্যাত এক গণিতজ্ঞ এবং অধুনা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিঙের পদপ্রদর্শক ছিলেন অ্যালান টিউরিং। ১৯১২ সালে তাঁর জন্ম হয় লন্ডনে। একজন সফল বিজ্ঞানী হলেও তিনি ছিলেন সমকামী। সেই সময়ে ব্রিটেনে সমকামিত্বকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। ৪১ বছর বয়সে তিনি ১৯ বছরের এক যুবকের প্রেমে পড়েন এবং শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন। যার দরুণ তাঁকে বিচারের সম্মুখীনও হতে হয়। মাত্র ৪১ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয় তাঁর বাড়ি থেকেই।
জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান
শুধু ভারতের তো নয়, গোটা বিশ্বের বিজ্ঞান চর্চায় জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান কখনই সংক্ষেপে লেখা সম্ভব নয়। তবে এককথায় বলতে গেলে গাছেরও যে প্রাণ রয়েছে, সেই তত্ত্বকে প্রথমবার গোটা বিশ্বের সামনে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন তিনি। এমনকি, আধুনিক সময়ে যে বেতার, বা রেডিও ব্যবহার করা হয়, সেই রেডিও রিসিভারের আবিষ্কারকও ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুই। কিন্তু সেই সময়কার ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তিনি কখনই সেই কৃতিত্ব বা সম্মান পাননি। তাঁর আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই রেডিও তৈরি করে তার কৃতিত্ব নিয়ে নেন ইতালির বিজ্ঞানী গুগলিলমো মার্কোনি। কোনও তারের ব্যবহার ছাড়াই যে বেশি দূরত্বে থাকা দুই কেন্দ্রে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব, সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে দেখিয়েছিলেন বলেই জগদীশচন্দ্র বসুকে বেতার যোগাযোগের জনক বলা হয়ে থাকে।
সুতরাং, সবশেষে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ব্রিটেনের ৫০ ইউরোর নোটে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ছবি ছাপা হচ্ছে না। এই জন্য একাধিক বিজ্ঞানীর নাম মনোনীত হলেও শেষ পর্যন্ত অ্যালান টিউরিংয়ের ছবি ছাপা হয়েছে।
ব্রিটেনের ৫০ পাউন্ডের নোটে ছাপা হচ্ছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ছবি।
২০১৮ সালে জগদীশচন্দ্র বসু, স্টিফেন হকিং-সহ কয়েকশো বিজ্ঞানীর নামে মনোনয়ন জমা পড়ে। কিন্তু ২০১৯ সালে নতুন ৫০ পাউন্ডের নোটে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান টিউরিংয়ের ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড।