দিনকয়েক আগেই উত্তর ভারতের লাগাতার বৃষ্টির জেরে ডুবতে বসেছিল রাজধানী নয়াদিল্লির ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। বর্তমানে নেমে গিয়েছে যমুনা নদীর জলস্তর। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বন্য-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় গত ক'দিন ধরে যেভাবে নানা ভিডিয়ো ভাইরাল হচ্ছে, তা এখনও বিদ্যমান।
যেমন ফেসবুকে একটি ভিডিয়ো খুব শেয়ার করা হচ্ছে। ১০ মিনিটের বেশি দীর্ঘ এই ভিডিয়োতে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের দৃশ্য ধরা পড়েছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি ভেসে যেতে। কোথাও আবার নদীর গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে বাড়ি। এই ভিডিয়োটি শেয়ার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা হচ্ছে যে, এটি দিল্লির দৃশ্য।
জনৈক নেটিজেন ভিডিয়োটি শেয়ার করে লিখেছেন, "দিল্লিতে কি ভয়াবহ অবস্থা #Delhi."
প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভিডিয়োটি প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ দেখে ফেলেছেন, ৭০০০-এর মানুষ ভিডিয়োটি শেয়ার করেছেন।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক টিম অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ক্লিপে যে ভিডিয়োগুলি ব্যবহার করা হয়েছে তার কোনওটি দিল্লির নয়। একাধিক পুরনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভিডিয়ো ব্যবহার করে মিথ্যে ছড়াতে এই দাবি করা হচ্ছে।
কীভাবে জানা গেল সত্যি
যেহেতু ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োটিতে ইংরাজি হরফে NW লেখা একটি লোগো দেখা যাচ্ছিল, সেই কারণে আমরা এই নিয়ে কিওয়ার্ড সার্চ করি ও NA Weather নামের একটি ভ্যারিফায়েড ইউটিউব চ্যানেল খুঁজে পাই। সেই চ্যানেলের সব ভিডিয়োতেই এই লোগো ব্যবহার করা হয়েছিল। এই চ্যানেলের ভিডিয়োগুলি দেখলে বোঝা যায় যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দৃশ্য এখানে তুলে ধরা হয়।
এর থেকেই আন্দাজ করা যায় যে আসল ভিডিয়োটি এই চ্যানেলের হতে পারে। এরপর আমরা ওই চ্যানেলে ১০ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের আসল ভিডিয়োটি খুঁজে পাই যা ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি আপলোড করা হয়েছিল।
কার্যত এর থেকেই একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই ভিডিয়োগুলি সাম্প্রতিক দিল্লি বন্যার হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, জলস্তর বেড়ে দিল্লিতে বন্যা পরিস্থিতি চলতি জুলাই মাসের ১০ তারিখের পর সৃষ্টি হয়। ওই চ্যানেলে আপলোড হওয়া আসল ভিডিয়োটি নীচে দেখা যাবে।
এরপর আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি যে আসল ভিডিয়োতে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভিডিয়োগুলি শেয়ার হয়েছে তার উৎস কী...
যেমন, প্রথম ভিডিয়োতে একটি ক্য়ানাল দিয়ে কিছু জঞ্জাল ভেসে আসতে দেখা যাচ্ছে। এর কিফ্রেম রিভার্স সার্চ করে আমরা একটি চিনা ওয়েবসাইটে ওই একই ভিডিয়ো খুঁজে পাই যা ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই প্রকাশ হয়েছিল।
এরপরের যে ভিডিয়োটিতে বিরাট জলোচ্ছ্বাসকে বহু গাড়ি ও বাড়ি গ্রাস করে নিতে দেখা যাচ্ছে, সেটি আসলে ২০১১ সালে জাপান সুনামির দৃশ্য। এই ভিডিয়োটি আগেও মিথ্যা খবর পরিবেশন করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছিল।
পরবর্তী ভিডিয়োতে একটি পাহাড়ে পাথরের চাঁই ভেঙে ধস নামতে দেখা যাচ্ছে। এই ভিডিয়োটি কোথাকার যা নির্দিষ্ট না করা গেলেও এটি ২০১০ সাল থেকে ইউটিউবে রয়েছে এবং হিমাচল প্রদেশের পাঙ্গি উপত্যকার ঘটনা বলে আপলোড করা হয়েছিল।
এরপর একটি ভিডিয়োতে কাদামাটির স্রোতকে দুটি বাড়ি ভাসিয়ে একটি খালে মিশে যেতে দেখা যাচ্ছে। এর কিফ্রেম সার্চ করে আমরা একটি চিনা ওয়েবসাইটে বন্যা সংক্রান্ত খবর খুঁজে পাই যা ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশ পায়। ভিডিয়োটি কোথাকার তা নির্দিষ্ট না করা গেলেও এর সঙ্গে সাম্প্রতিক দিল্লি বন্যার কোনও যোগ নেই।
পরের ভিডিয়োতে ধুলোর টর্ডেনোর দৃশ্য ধরা পড়ছে। এর স্ক্রিনশট রিভার্স সার্চ করলে আমরা একটি রাশিয়ান ওয়েবসাইটের খবর খুঁজে পাই। ২০২০ সালে জুন মাসের এই খবরে লেখা হয় যে এটি একটি হ্যারিকেন যা কাজাকাস্তানে হানা দিয়েছিল।
আরেকটি ভিডিয়োতে একটি রাস্তার উপর ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে একটি লাল রঙের বাস যেতে দেখা যাচ্ছে। এর আসল ভিডিয়োটি আমরা ইউটিউবে খুঁজে পাই যা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে আপলোড করে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, লোসারি সিরেবন এলাকার ঝড়-বৃষ্টি। কিওয়ার্ড সার্চ করলে দেখা যায়, লোসারি সিরেবন ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রভিন্স।
বাকি ভিডিয়োগুলিও যে পুরনো এবং দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কহীন তাও আমরা খুঁজে পেয়েছি। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে কীভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্পর্কহীন ভিডিয়ো দিল্লি বন্যার নামে মিথ্যে দাবিতে ছড়ানো হচ্ছে।
ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে বন্যায় দিল্লির ভয়াবহ অবস্থা।
ভাইরাল হওয়া সবকটি ভিডিয়োই পুরনো এবং দিল্লির বন্যার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।