

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে, প্রকাশ্য রাস্তার উপরে একজনকে ইলেকট্রিক পোস্টে বেঁধে বেধড়ক মারধর করছে দুই যুবক এবং তাদের ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু মানুষ। অন্যদিকে রাস্তার উপরে পড়ে রয়েছে জল তোলার জন্য ব্যবহৃত একটি ইলেকট্রিক মটর। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বাজারে সবজির গাড়ি রাখার জন্য ধর্মীয় মৌলবাদীরা এক হিন্দু যুবককে বেধড়ক মারধর করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “#WestBengal এই ছেলেটিকে বেঁধে মারধর করা হচ্ছে কারণ এটি একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা এবং তাদের বাজার। এই হিন্দু ছেলেটি এখানে তার সবজির গাড়ি রেখেছিল...>এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরা হিন্দু ছেলেটিকে বেঁধে মারধর করে এবং বলে, "তোমরা কাফেরদের এখানে কোন স্থান নেই।” (সব বানান অপরিবর্তিত)

ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গের তো নয়ই, এমনকি এর সঙ্গে ভারতেরও কোনও সম্পর্ক নেই। বরং এটি ২০২৫ সালের ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লাকসাম বাজারে একটি মসজিদ থেকে জলের মটর চুরির অভিযোগে দুই মুসলিম যুবককে মারধরের ভিডিও।
সত্য উন্মোচন
ভাইরাল ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করার সময় সেটির ৯ সেকেন্ডে এক যুবকের জার্সির পিছনে ‘ত্রিনয়নী যুব সংঘ’ নামক একটি ক্লাব এবং এর ঠিকানে হিসাবে ‘জগৎপুর, লালমাই, কুমিল্লা’ লেখা দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালালে ফেসবুকে এই একই নামের ক্লাবের একটি পেজ পাওয়া যায় এবং সেটিরও ঠিকানা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লালমাই এলাকার জগৎপুর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা থেকে সন্দেহ তৈরি হয় যে ভাইরাল ভিডিওটি বাংলাদেশের হলেও হতে পারে। অন্যদিকে যে পোস্টে যুবকটিকে বেঁধে মারধর করা হচ্ছে সেটির উপরে ‘গাউছিয়া রেস্তোঁরা’ নামক একটি ব্যানার দেখা যায়।
তাই এরপর ভাইরাল ভিডিও সম্পর্কে জানতে সেটি থেকে একাধিক কিফ্রেম সংগ্রহ করে সেগুলি গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর একটি ফেসবুক প্রোফাইলে এই একই ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “মসজিদের পানির মটর চু*রি * করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, গ্রামবাসী একটু ধোলাই দিচ্ছে।” এই একই দাবি-সহ আরও একাধিক বাংলাদেশ ভিত্তিক ফেসবুক প্রোফাইল থেকেও এই একই ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে।

এরপর উক্ত তথ্যের উপরে ভিত্তি করে এ বিষয়ে একাধিক কিওয়ার্ড সার্চ করলে চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর ‘Green Laksam Media’ নামক একটি বাংলাদেশ ভিত্তিক নিউজ পোর্টালে ভাইরাল ভিডিও-র একাধিক স্ক্রিনশট-সহ একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেই পোস্টের ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়েছে, “লাকসাম উপজেলার জংশন লেকের সাথে লাকসাম জংশন মসজিদের মটর চুরি করতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের কাছে হাতেনাতে ধরা খায়।”

পাশাপাশি, এই সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চালালে Omor Faruk নামক এক বাংলাদেশি যুবকের ফেসবুক প্রোফাইলে এই ঘটনার একটি বিস্তারিত ভিডিও পাওয়া যায়। সেই ভিডিও-র ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “আজ রাত দুইটায় লাকসাম রেলওয়ে জংশন মসজিদের মোটর চুরি করা কালে তিনজন চোর ধরা পড়ে।” পাশাপাশি, ওমর ফারুকের তরফে শেয়ার করা ভিডিওতে ভাইরাল ভিডিও-র বাঁধা যুবকের পিছনে অপর আর এক যুবকেও বাঁধা অবস্থায় এবং সেখানে উপস্থিত দুই ব্যক্তিকে পুরো ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে দেখা যায়। সেই ভিডিও থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালের ১৩ অক্টোবর রাত দুটো নাগাদ বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লাকসাম বাজারের একটি মসজিদ থেকে জলের মটর চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে মোট তিন যুবক।
তবে উক্ত তিন যুবকের মধ্যে ফারুক নামের এক যুবক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে আফজাল এবং সাক্ষু নামের দুই যুবককে স্থানীয়রা ধরে ফেলে এবং তাদের দু’জনকে লাকসাম বাজারের একটি ইলেকট্রিক পোস্টে বেঁধে বেধড়ক মারধর করে স্থানীয়রা। পাশাপাশি, বিষয়টি সম্পর্কে জানতে আমরা ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনিও আমাদের নিশ্চিত করেন যে ভাইরাল ভিডিও-র দুই যুবকই মুসলিম এবং তাদের মসজিদের মটর চুরির অভিযোগে মারধর করা হয়েছিল। এই ঘটনার সঙ্গে কোনও রকম ধর্মীয় বিবাদের সম্পর্ক নেই। পাশাপাশি, আমরা গুগল ম্যাপেও বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লাকসাম বাজারের এই ঘটনাস্থলটি খুঁজে বের করি। নীচে গুগল ম্যাপে ঘটনাস্থলটি দেখা যাবে।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বাজারে হিন্দু যুবককে মারধর দাবি করে ছড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশের ভিন্ন ঘটনার ভিডিও।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বাজারে সবজির গাড়ি রাখার জন্য ধর্মীয় মৌলবাদীরা এক হিন্দু যুবককে বেধড়ক মারধর করেছে।
ভাইরাল ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারতের নয়। বরং এটি বাংলাদেশের লাকসাম বাজারের একটি মসজিদ থেকে জলের মটর চুরির অভিযোগে দুই মুসলিম যুবককে মারধরের দৃশ্য।