সুরাজউদ্দিন মণ্ডল: লোকসভা ভোট যতই এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে বঙ্গ রাজনীতির পারদ। রাজ্যের ৪২টি আসন কার দখলে থাকবে সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবকটি দল। আর সেই লক্ষ্যে প্রচারের ক্ষেত্রেও অবলম্বন করা হচ্ছে বিভিন্ন কৌশল। বাইক মিছিল, পথসভা ও জন সম্মেলনের পাশাপাশি প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ভ্যান। এই সব প্রচার ভ্যানে দলীয় পতাকা ও ব্যানার লাগিয়ে নিজেদের বার্তা তুলে ধরছে রাজনৈতিক দলগুলি।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনই একটি প্রচার ভ্যানের ভিডিয়ো ভাইরাল হচ্ছে। গেরুয়া রঙের ওই ভ্যানে পদ্ম ফুলের চিহ্ন ও ব্যানার থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় সেটি বিজেপির প্রচার ভ্যান। ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, কোনও একটি গ্রামে প্রচার উদ্দেশ্যে ভ্যানটি প্রবেশ করেছে। আর তখন কিছু স্থানীয় মহিলা ভ্যানটিকে আটকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করছে এবং সেটিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই ভিডিয়োটি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, এটি পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভিডিয়োটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন, “বাংলায় বিজেপির অবস্থা!!!” অর্থাৎ তার বক্তব্য অনুযায়ী ভিডিয়োটি পশ্চিমবঙ্গের কোনও স্থানের। এবং গ্রামের মহিলারা বিজেপির প্রচার ভ্যানকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এই একই ভিডিয়োটি পোস্ট করে অপর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “খেলা শুরু।” পাশাপাশি তিনি ক্যাপশনে একাধিক হ্যাশট্যাগও ব্যবহার করেছেন। তবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বেঙ্গল রিজেক্ট বিজেপি।’ সরাসরি উল্লেখ না করা হলেও ক্যাপশনে ‘খেলা শুরু’ ও হ্যাশ ট্যাগের মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে এটি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলার ঘটনা। (সব পোস্টের ক্যাপশনের বানান অপরিবর্তিত।) এবং এমনই একটি পোস্টের আর্কাইভ এখানে দেখা যাবে।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল দাবিটি বিভ্রান্তিকর। মহিলাদের বিজেপির প্রচার গাড়ি তাড়িয়ে দেওয়া ভিডিয়োটি ২০২০ সালের বিহারের মুজাফফারপুরে ঘটেছিল।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
ভাইরাল ভিডিয়োটির তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সামনে দুটো প্রশ্ন উঠে আসে। একটি হল, ভিডিয়োটি সাম্প্রতিক অর্থাৎ ২০২৪-এর লোকসভা ভোট প্রচারের সময়ের কিনা? অপরটি হল, ভিডিয়োটি বাংলার কোনও স্থানের কিনা?
প্রথমত, বাংলায় বিজেপির অবস্থা দাবি করে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ভিডিয়োটি ভাইরাল করা হয়েছে সেটি সন্দেহজনক। কারণ ভিডিয়োতে মহিলারা যে ভাষায় কথা বলছেন সেটা বাংলা নয়। বরং ভালো করে শুনলে বোঝা যায় ভাষাটি হিন্দি ঘেঁষা। তাই ভিডিয়োটি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলার কিনা সেই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদের তরফে বিভিন্ন কিওয়ার্ড ও কী-ফ্রেম সার্চ করা হয়।
তখন আমরা লক্ষ্য করি ২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই একই ভিডিয়ো এক ‘এক্স’ ব্যবহারকারীর তরফেও পোস্ট করা হয়েছে। এবং ভিডিয়োটি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, “যখন ৯ বছর হিন্দুদের জিজ্ঞাসা না করে সব কাজ নিজের পছন্দ মতো করবে, তখন ভোট চাইতে গেলে এমনই ক্ষোভের মুখে পড়তে হবে।” এই টুইট থেকে আমাদের প্রথম প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভিডিয়োটি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের সময়ের নয়।
जब 9 साल हिंदुओ को पूछोगे नहीं सारे काम पसमंदाओं के करोगे तो वोट मांगने जाओगे तो जनता के इसी आक्रोश का सामना करना ही पड़ेगा? pic.twitter.com/9AbziPJSL8
— Ch.Anupam Gujjar (@Anupam_haryana) September 9, 2023
এর পরে আমরা খোঁজার চেষ্টা করি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর। অর্থাৎ বাংলার সঙ্গে এই ভিডিয়োর কোনও সম্পর্ক আছে কিনা। তখন আমাদের নজরে আসে ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবরের একটি ফেসবুক ভিডিয়ো। ভিডিয়োটি পোস্ট করে লেখা হয়েছে, “মুজাফফারপুরের কুধনির বিজেপি বিধায়ক কেদার প্রসাদ গুপ্তার প্রচারের গাড়ি যখন একটি গ্রামে পৌঁছায়, তখন মহিলারা সেটিকে লক্ষ্য করে এতটাই অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করলেন যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। এমনকি তারা গাড়ির পোস্টার ছিঁড়ে সেটিকে ফিরে যেতে বাধ্য করে।”
২ মিনিট ২০ সেকেণ্ডের সেই ভিডিয়োটি ভালো করে পর্ষবেক্ষণ করলে বোঝা যায় ভাইরাল ভিডিয়োটি সেই ভিডিওর অংশবিশেষ। এই ভিডিয়োর ১ মিনিট ২৮ সেকেণ্ড থেকে ১ মিনিট ৫৮ সেকেণ্ড পর্যন্ত কেটে ভাইরাল ভিডিয়োটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি এই ভিডিয়োর ১ মিনিট ৮ সেকেণ্ডে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গাড়িতে যে ব্যানার লাগানো আছে তাতে লেখা আছে, আত্মনির্ভর বিহার। অর্থাৎ এ থেকে আমরা আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় যে, ভিডিয়োটির সঙ্গে বাংলার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং সেটি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় মুজাফফরপুরের কুধনি এলাকার ঘটনা।
পাশাপাশি আমরা সাল তারিখ সহ কিওয়ার্ড সার্চ করলে দেখতে পাই ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর এই একই ঘটনার কথা নিজেদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ‘জনসত্তা'। সেখানে লেখা হয়েছে, “বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রচার করতে আসা অনেক জনপ্রতিনিধিই জনরোষের মুখে পড়েছেন। এমনই একটি ঘটনা সামনে এসেছে মুজফফরপুরের কুধনি এলাকার একটি গ্রাম থেকে। বিজেপি বিধায়ক কেদার প্রসাদ গুপ্তের প্রচারের গাড়ি এলে গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তারা গালিগালাজ করেন। পাশাপাশি গাড়িটিকে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। এই ঘটনার একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে।”
এর থেকেই প্রমাণ হয় যে, বিজেপির প্রচার ভ্যান লক্ষ্য করে মহিলাদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ এবং গাড়িটিকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভিডিয়োর সঙ্গে লোকসভা নির্বাচন ও বাংলার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং ভিডিয়োটি ২০২০ সালের বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের সময় মুজফফরপুরের কুধনি এলাকার একটি গ্রামের।
অশ্লীলভাষায় আক্রমণ করে বাংলায় বিজেপির প্রাচার ভ্যান তাড়িয়ে দিল মহিলারা।
বিজেপির প্রচার ভ্যান লক্ষ্য করে মহিলাদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ এবং গাড়িটিকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভিডিয়োর সঙ্গে লোকসভা নির্বাচন ও বাংলার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং ভিডিয়োটি ২০২০ সালের বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের সময় মুজফফরপুরের কুধনি এলাকার একটি গ্রামের।