EXCLUSIVE: চাপড়ায় সরস্বতী প্রতিমা 'ভেঙে' হাজতে বিজেপি নেতারা? আমাদের তদন্তে উঠে এল অন্য তথ্য 

গত ২ ফেব্রুয়ারি নদিয়ার চাপড়া থানার কলিঙ্গ এলাকার চড়ুই-টিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙাকে কেন্দ্র করে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়ায়। পরবর্তীতে চাপড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে ওই মণ্ডপের পাশেই নতুন একটি মণ্ডপ তৈরি করে পুজো সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে এবং গোটা ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে। পরবর্তীতে পুলিশ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৪ বিজেপি নেতাকে গ্রেফতার করে। এই ৪ বিজেপি নেতার গ্রেফতারের আসল কারণ উঠে এল আজতক ফ্যাক্ট চেকের অনুসন্ধানে।

Advertisement
EXCLUSIVE: চাপড়ায় সরস্বতী প্রতিমা 'ভেঙে' হাজতে বিজেপি নেতারা? আমাদের তদন্তে উঠে এল অন্য তথ্য 

এ বছরের সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছে একাধিক চমকে দেওয়া খবর। কোথাও পুজো করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ, তো আবার কোনও স্কুলে পুজোই হচ্ছে না, এমন ঘটনাও সামনে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে। এরই মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি নদিয়ার চাপড়া থানার কলিঙ্গ এলাকার চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙাকে কেন্দ্র করে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়ায়। পরবর্তীতে চাপড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে ওই মণ্ডপের পাশেই নতুন একটি মণ্ডপ তৈরি করে পুজো সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে এবং গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করে।

এই সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এই ঘটনা সংক্রান্ত একটি ভিডিও। যে ভিডিওতে পুলিশকে ৪ জন ব্যক্তিকে একটি প্রিজন ভ্যানে তুলতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিও ক্লিপটি শেয়ার করে তার ক্যাপশন ও ভয়েসওভারে দাবি করা হয়েছে, চাপড়ায় সরস্বতী প্রতিমা ভাঙার অভিযোগে বিজেপির স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য-সহ মোট ৪ জন বিজেপি নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “নদিয়ার চাপড়ায় সরস্বতীর মূর্তি ভেঙ্গে গ্রেফতার বিজেপির কলিঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য প্রসেনজিৎ ঘোষ !! মূল চক্রান্তকারীরা হলো দেবাশীষ ঘোষ, মানিক ঘোষ, প্রসেনজিৎ ঘোষ ও পিন্টু ঘোষ!!”

তবে আজকতের ফ্যাক্ট চেক টিমের অন্তর্তদন্তনে উঠে এসেছে যে এই চার ব্যক্তিকে ঠিক মূর্তি ভাঙার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেনি। বরং ওই ঘটনার পর পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

কী কারণে গ্রেফতার ৪ বিজেপি নেতা?

চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙা সংক্রান্ত বিষয় এবং ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর সময় গত ৪ ফেব্রুয়ারি এবিপি আনন্দের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে এই একই ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, নদিয়ার চাপড়ায় সরস্বতী প্রতিমা ভাঙা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় ও ঘটনার তদন্তে গেলে পুলিশকে বাধা এবং পুলিশের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য-সহ ৪ জন।

Advertisement

এরপর এই সংক্রান্ত পরবর্তী অনুসন্ধানে ক্যালকাটা নিউজের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙার ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ সেখানে পৌঁছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনাস্থল থেকে ২০০ মিটার দূরে নতুন একটি মণ্ডপ তৈরি করে পুজোর ব্যবস্থা করে। এরপর পুলিশ রাতে ঘটনাস্থল থেকে ভাঙা প্রতিমা উদ্ধার করতে গেলে ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসীদের পাশাপাশি স্থানীয় একাধিক বিজেপি নেতা-কর্মীরা পুলিশকে বাধা দেয়। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য-সহ ৪ বিজেপি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতরা হলেন কলিঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিজেপি সদস্য প্রসেনজিৎ ঘোষ, জিএস দেবাশীষ ঘোষ এবং দুই বিজেপি কর্মী মানিক ঘোষ ও পিন্টু ঘোষ।

ধৃত ৪ বিজেপি নেতা প্রসঙ্গে পুলিশের বক্তব্য:

চাপড়ায় সরস্বতী প্রতিমা ভাঙা এবং তার পরবর্তী সময়ে ৪ বিজেপি নেতাকে গ্রেফতার সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে জানতে আজতক ফ্যাক্ট চেকের তরফে নদিয়ার কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার এসপি শ্রী অমরনাথ কে-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আজতককে জানিয়েছেন, “ধৃত বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য-সহ ৪ বিজেপি নেতাকে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙার কারণে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং পুলিশের কাজে বাধা এবং পুলিশকে মারধর করার জন্য তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মূর্তি ভাঙার বিষয়টি এখনও তদন্ত চলছে। তবে এখনও পর্যন্ত মূর্তি ভাঙার অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।” এই একই তথ্য জানিয়েছেন কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অ্যাডিশনাল এসপি মাকওয়ানা মিটকুমার সঞ্জয়কুমারও।

পাশাপাশি গত ৭ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার ডিএসপি শিল্পী পাল চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙাকে কেন্দ্র করে ৪ বিজেপি নেতার গ্রেফতার প্রসঙ্গে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানে তাঁর কাছে ওই ৪ বিজেপি নেতার গ্রেফতারের আসল কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, “চাপড়ায় সরস্বতী প্রতিমা ভাঙার ঘটনায় আমরা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছি এবং তাতে যদি কোনও নাম উঠে আসে আমরা তাদের গ্রেফতার করব। তবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিমা ভাঙার কোনও অভিযোগ নেই। বরং ওই ৪ জনকে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কী জানা যাচ্ছে ধৃত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া FIR কপি থেকে?

এরপর আজতক ফ্যাক্ট চেক ধৃত ওই ৪ বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে গত ৪ ফেব্রুয়ারি চাপড়া থানায় এসআই মোঃ আজাহার উদ্দিন সেখের তরফে দায়ের করা এফআইআর কপিটি ভালো করে খতিয়ে দেখে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে এসআই আজাহার উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি বাহিনী পরবর্তী তদন্তের উদ্দেশ্যে চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমার ভাঙা অংশগুলি সংগ্রহ করতে গেলে প্রসেনজিৎ ঘোষ, দেবাশীষ ঘোষ, মানিক ঘোষ ও পিন্টু ঘোষ-সহ ১৫-২০ জনের ভিড় তাদেরকে বাধা দেয় এবং তাদের মারধর করে। এতে একাধিক পুলিশ কর্মী জখম হন। অবশেষে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বাধ্য হয়ে প্রসেনজিৎ ঘোষ, দেবাশীষ ঘোষ, মানিক ঘোষ ও পিন্টু ঘোষকে গ্রেফতার করে। 

পাশাপাশি এফআইআর কপি থেকে জানা যায় ধৃত ওই ৪ বিজেপি কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১২৬(২), ১১৭(২), ১২১, ১২১(২), ১০৯, ১৩২, ২২১, ৭৬ এবং ৩(৫) ধারায় মামলা দায়ের করেছে। মূলত এই ধারা গুলি সরকারি কর্মীদের উপরে হামলা, সরকারী কর্মীদের কাজে বাধা দেওয়া, অপরাধে সহায়তা করা বা উস্কানি দেওয়া এবং মহিলাদের উপরে হামলা এবং শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই প্রতিটি ধারা সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন। তবে এই ধারাগুলির কোনওটিই কোনও দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবহার করা হয় না।

Advertisement

কী জানিয়েছেন ধৃতদের উকিল?

এরপর ধৃতদের সম্পর্কে জানতে আজতক ফ্যাক্ট চেকের তরফে ধৃত ৪ বিজেপি নেতাদের উকিল সৌরভ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আমাদের জানান, “গত ৩ ফ্রেব্রুয়ারির রাতে পুলিশ চড়ুইটিপি গ্রাম থেকে সরস্বতী প্রতিমার ভাঙা অংশগুলি জোরপূর্বক নিয়ে যেতে চাইলে গ্রামবাসীরা সঠিক তদন্তের দাবিতে পুলিশকে বাধা দেয়। সেই সময় পুলিশ স্থানীয় চার বিজেপি নেতা প্রসেনজিৎ ঘোষ, দেবাশীষ ঘোষ, মানিক ঘোষ ও পিন্টু ঘোষকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি ধৃতদের কৃষ্ণনগর জেলা আদালতে পেশ করা হলে বিচারক ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেয়। পুলিশ তাদের এফআইআর কপিতে দাবি করেছে ওই চারজন পুলিশকে মারধর করেছে কিন্তু তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। সেই কারণে গতকাল অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগর জেলা আদালতের বিচারক ধৃতদের অন্তবর্তীকালীন জামিন প্রদান করেছেন। পুলিশ যে মিথ্যে অভিযোগ করেছিল তা আদালতের এই নির্দেশেই প্রমাণ হয়ে গেছে।”

কী বলছেন বিজেপির জেলা সভাপতি?

এরপর ধৃত কর্মীদের গ্রেফতারি প্রসঙ্গে জানতে নদিয়ার সাংগঠনিক জেলা বিজেপির সভাপতি অর্জুন বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আজতক বাংলা। তিনি আমাদের জানান, আসলে চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা করা ভেঙেছে সেই সংক্রান্ত প্রমাণ নষ্ট করার জন্য পুলিশ রাতে অন্ধকারে প্রতিমার ভাঙা অংশ নিতে সেখানে গিয়েছিল। ঘটনাটি বুঝতে পেরে গ্রামবাসীদের পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় কর্মীরা পুলিশকে বাধা দেয়। তখন পুলিশ একটি মিথ্যে মামলা দায়ের করে আমাদের ৪ জন কর্মীকে গ্রেফতার করে। মূলত পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও পুলিশকে মারধর করার জন্য গ্রেফতার করা হয়। এমনকি এক শ্রেণির মানুষের তরফে যারা তৃণমূল সমর্থক তাদের তরফে প্রচার করা হচ্ছে, আমাদের কর্মীদের মূর্তি ভাঙার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যে।

এখনও পর্যন্ত সরস্বতী প্রতিমা ভাঙার অভিযোগে কাউকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে?

চাপড়ার চড়ুইটিপি গ্রামে সরস্বতী প্রতিমা ভাঙার অভিযোগে কেবলমাত্র বিজেপি নেতা নয় এমনকি অন্য কাউকেও গ্রেফতার করা হয়ে থাকলে সেই সংক্রান্ত খবর অবশ্যই প্রথম শ্রেণির বাংলা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হবে। কিন্তু প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত এই সংক্রান্ত একাধিক কিওয়ার্ড সার্চে এমন কোনও তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি যা থেকে এই দাবির সত্যতা প্রমাণ হয়।

POST A COMMENT
Advertisement