দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি। কিছু কিছু জায়গায় জল নামলেও ভোগান্তি কমছে না। আর এই আবহে মঙ্গলবারও ডিভিসিকে নিশানা করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত সপ্তাহেই, DVC-কে কাঠগড়ায় তুলে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। পাল্টা চিঠিতে কেন্দ্রীয় জলশক্তিমন্ত্রী সি আর পাটিল দাবি করেন, সব সময়ের মতো এবারও ঐকমত্য়ের ভিত্তিতে, প্রতিটি স্তরে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করেই, জল ছেড়েছে দামোদর ভ্য়ালি রিভার রেগুলেশন কমিটি (DVRRC)। মুখ্য়মন্ত্রী DVC-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরই দামোদর ভ্য়ালি রিভার রেগুলেশন কমিটি (DVRRC) থেকে পদত্যাগ করেন রাজ্যের বিদ্যুৎ সচিব শান্তনু বসু, এবং রাজ্যের সেচ ও জলপথ দফতরের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবারও, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে DVC-র বিরুদ্ধে সুর চড়ান মুখ্যমন্ত্রী। বীরভূমে প্রশাসনিক বৈঠকের পর তিনি বলেন, 'ডিভিসি প্রতিবছর জল ছাড়ে আর ম্যান মেড বন্যা হয়। বাংলায় বর্ষার কারণে বন্যা হয় না, ডিভিসি-র ছাড়া জলে বন্যা হয়।' তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবির মাঝেই এমন এক নথি সামনে এসেছে, যা থেকে জল্পনা বাড়ছে, রাজ্য আগেই জানত জল ছাড়ার বিষয়টি জানত।
রাজ্য সরকারের একটি মেমো বা বিজ্ঞপ্তি ফাঁস হয়েছে। নবান্নের সেই বিজ্ঞপ্তিটি ১৭ সেপ্টেম্বরের। সেখানে হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জেলা শাসকদের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আগাম সতর্কতা জারি করে সতর্ক করেছে রাজ্য সরকার। ডিভিআরআরসি এবং সিডব্লিউসি জানিয়েছে, আবহাওয়ার কারণে মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধারে জলস্তর দ্রুত বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ডিভিআরসি আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছাড়বে। তার ফলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলে মোকাবিলা করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সরাকারি চিঠিতে বলা হয়েছে নিচু এলাকার বাসিন্দাদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ারও।
গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম চিঠিটি লেখেন মমতা। কিন্তু এই ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তার তিন দিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর রাজ্যে ‘বন্যা পরিস্থিতি’ তৈরি হতে পারে বলে আটটি জেলাকে সতর্ক করেছিল নবান্ন। ১৭ তারিখের মেমো বলছে, ওই দিন হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার জেলাশাসকদের মেমো পাঠায় রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। একই সঙ্গে মেমোতে পরামর্শ দেওয়া হয়, প্লাবিত হতে পারে এমন এলাকার মানুষকে প্রয়োজনে যেন নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়।
বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের ওই মেমোতে বলা হয়েছিল যে, কংসাবতী বাঁধ থেকেও জল ছাড়া হতে পারে। তেমন হলে পূর্ব মেদিনীপুরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে। কংসাবতী বাঁধের সঙ্গে ডিভিসি-ও জল ছাড়ায় হলদি ও রূপনারায়ণের জল স্তর বাড়বে। এমন সতর্কতা জেলায় জেলায় পাঠানোর পরেও কেন রাজ্য সরকার ডিভিসি কিছু জানায়নি বলে দাবি করছে? মঙ্গলবার এই প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা মন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, ‘‘ডিভিসি রাজ্যকে জানিয়েছিল না জানায়নি, তা আমি জানি না। তবে কোনও রকম সতর্কতা জারি হলেই আমরা প্রস্তুতি নিতে বলি। শুধু সেই সময়েই নয়, মে মাস থেকেই আমার দফতরে বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।’’
এর আগে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির জবাব দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী সিআর পাতিল। চিঠিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানিয়েছেন, মাইথন এবং পাঞ্চেত রিজার্ভার পরিচালনা করে দামোদর ভ্যালি রিজার্ভার রেগুলেশন কমিটি বা ডিভিআরআরসি। পশ্চিমবঙ্গের চিফ ইন্জিনিয়াররাও সেই কমিটির সদস্য। রাজ্যের অনুরোধ মেনে ১৪-১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভার থেকে জল ছাড়া ৫০% কমানো হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৭ সেপ্টেম্বর সকালে বড় বিপর্যয় এড়াতে বাঁধের জল ছাড়তে বাধ্য হয় ডিভিআরআরসি। যদিও ৪.২৩ লক্ষ কিউসেকের বদলে ২.৫ লক্ষ কিউসেক জলই ছাড়া হয়েছিল তখন। জল না ছাড়া হলে দক্ষিণবঙ্গ সহ একটা বিস্তীর্ণ অংশে বড় বিপর্যয় নেমে আসত। তিনি চিঠিতে আরও লেখেন, রাজ্য সরকারকে জল ছাড়ার আগে সবটা জানান হয়েছিল। রাজ্যের প্রতিনিধি রয়েছে ডিভিসিতে। প্রতিনিধির দ্বারা সব তথ্য আগেই দেওয়া হয়েছিল। তারপরই জল ছাড়া হয়েছে। আর বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে সময় বুঝে যে জল ছাড়তে হবেই, তাও জানে রাজ্য। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে না জানিয়ে জল ছাড়া হয়েছে এমন অভিযোগ ঠিক নয়। পাশাপাশি, দুটি রিজার্ভারের ডি-সাইটেশন টেকনো-ইকনমিক্যালি ভায়াবল নয় বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। তবে, রিজার্ভার দুটির ইনফ্লো ঠিক রাখতে একটা বড় এলাকা জুড়ে সেডিমেন্ট ম্যানেজমেন্ট করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রের তরফে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বরাদ্দ অনুযায়ী টাকা দেওয়া এবং মন্ত্রকের তরফে সব রকম সহযোগিতার কথা জানানো হয়েছিল চিঠিতে।