1919 to 2025: History of Kolkata Metro: কলকাতা মেট্রো যে শুধুই পরিবহনের মাধ্যম, তা কিন্তু নয়। এই মেট্রো দেশের প্রায় একশো বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি বলা যেতে পারে। গত এক শতাব্দীতে কলকাতা ও শহরতলি বদলেছে অনেকটাই। কিন্তু এত বছর আগেই ব্রিটিশরা কীভাবে মেট্রোর বিভিন্ন রুটের পরিকল্পনা করেছিলেন, তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। ১৯১৯ সালে শিমলার ইম্পোরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে বিক এ. ক্রামের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি কলকাতায় মেট্রোর প্রস্তাব করে। সেই প্ল্যানিংয়ে বলা হয়েছিল, বাগমারি থেকে হুগলি নদীর নিচ দিয়ে টানেলের মাধ্যমে বেনারস রোড, সালকিয়া রুটে ১০.৪ কিমি লম্বা মেট্রো লাইন হবে। খরচ হবে £৩,৫২৬,১৫৪ (৬৯০ কোটি টাকারও বেশি)। ব্রিটিশরা এই প্ল্যানে অগ্রাধিকারও দিয়েছিল। কিন্তু তখন ব্রিটিশ শাসনের টলমল অবস্থা। অর্থের অভাবে ১৯২৩ সালে সেই প্রকল্প স্থগিত হয়। তবে এটা সত্যিই চমকপ্রদ যে, আজ গঙ্গার তলা দিয়ে যে মেট্রো বাস্তবায়িত হয়েছে, তার পরিকল্পনা প্রায় ১০০ বছর আগেই করেছিলেন ব্রিটিশরা।
১৯৪৯: বিধানচন্দ্র রায় উদ্যোগ নিলেন
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায় ১৯৪৯ সালে মেট্রো রেল প্রকল্প নিয়ে নতুন করে কাজ শুরুর নির্দেশ দেন। ফ্রান্স থেকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও আনা হয়। সেই কমিটি কলকাতায় বিভিন্ন রূটে পরীক্ষানিরীক্ষা চালায়। তারপর প্ল্যান কীভাবে বাস্তবায়িত করা হবে, তার একটি রিপোর্টও পেশ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আর বাস্তবায়ন হয়েনি।
১৯৬৯: ‘Metropolitan Transport Project’
কলকাতা মেট্রোর বাস্তবায়নের সূচনা বলা যেতে পারে ১৯৬৯ সালে। সে বছরর
Metropolitan Transport Project (MTP) গঠিত হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই প্রথম, ৯৭.৫ কিলোমিটার মেট্রো প্রকল্পের প্ল্যান আঁকা হয়।
L আকৃতির এই রূটে মোট তিনটি মেট্রো রুট তৈরি হবে বলে ঠিক হয়।
দমদম থেকে টালিগঞ্জ (ব্লু লাইন)
বিধাননগর থেকে রামরাজাতলা(আপাতত হাওড়া ময়দান) (গ্রিন লাইন)
দমদম থেকে ঠাকুরপুর (ব্লু ও পার্পল লাইন)
এই প্ল্যান খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞ কমিটি জানায়, দমদম থেকে টালিগঞ্জ উত্তর থেকে দক্ষিণ রুটেই কাজ শুরু করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই মতোই ১৯৭৩ সালে মেট্রোর কাজ শুরু হয়। প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রায় ১১ বছর পর, আসে সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮৪ সালে প্রথম মেট্রোর পরিষেবা চালু হয়।
ব্রিটিশদের ভাবনা, ভারতীয়দের প্ল্যানিং ও বাস্তবায়ন
কলকাতা মেট্রোর ভাবনা ব্রিটিশদের হলেও, এর খাতায় কলমে প্ল্যানিং ও বাস্তবায়নের পুরোটাই কিন্তু ভারতীয়দেরই। তাই মেট্রো আসলে ব্রিটিশদের কৃতিত্ব, এমনটা বললে তা নিতান্তই যুক্তিহীন একটি বিষয় হবে। তাছাড়া এহেন বড় কোনও প্রকল্পের প্ল্যানিং ও বাস্তবায়ন মোটেও ছেলেখেলা নয়। এক প্রকার 'ট্রায়াল অ্যান্ড এরর' দিয়েই কাজ করেছিলেন ইঞ্জিনিয়াররা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলকাতা মেট্রো তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল মাটির ধরন। কলকাতায় মাটি খুঁড়তে শুরু করলে, খুব অল্প গভীরতাতেই ভূর্গভস্থ জলস্তর পাওয়া যায়। রীতিমতো কাদা, পলি, এঁটেল মাটি। এই মাটি কেটে তার তলায় সূড়ঙ্গ করার ক্ষেত্রে বহু ঝুঁকি রয়েছে। ধসের আশঙ্কা তো থাকেই। তাছাড়া কলকাতার ব্যস্ত এলাকাগুলিতে জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসনও যে সময়সাপেক্ষ ও চ্যালেঞ্জিং, তা বলাই বাহুল্য। আর সেই কারণেই ১৭ কিমি মেট্রো গড়ে তুলতে প্রায় ২৩ বছর সময় লেগেছিল।
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ এ ফার্স্ট ফেজের কাজ শেষ হয় এবং সম্পূর্ণ মেট্রো নেটওয়ার্ক চালু হয়।
এর পর ধাপে ধাপে সম্প্রসারণে ব্লু, গ্রিন, পারপল ও ওরেঞ্জ লাইন আসে। আজ কলকাতা মেট্রোর অধীনে ৫০টি স্টেশন রয়েছে। ২৯টি নির্মাণাধীন।
আজও রাজনৈতিক আস্ফালনের অস্ত্র এই মেট্রো
প্রায় ১০০ বছর আগে, মেট্রোর প্রস্তাব করেছিলেন ব্রিটিশরা। নিঃসন্দেহে তার বাস্তবায়নের কৃতিত্ব ভারতেরই। তবে ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিকদের পরিশ্রম, বুদ্ধির উর্ধ্বে, বারবার রাজনৈতিক শক্তি হিসাবেই আস্ফালন করা হয়েছে এই মেট্রোকে। আজও এই মেট্রোকে নিজেদের পরিকল্পনা ও চেষ্টার প্রতীক হিসেবেই তুলে ধরছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা।
তাই পরেরবার মেট্রো চড়ার সময় দুইটি জিনিস মাথায় রাখবেন। প্রথমত এই মেট্রোর পিছনে ব্রিটিশদের শতাব্দীপ্রাচীন পরিকল্পনার কথা। দ্বিতীয়ত, ভারত তথা বিভিন্ন দেশের ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকদের বুদ্ধি, পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ।