RG Kar Case: কারও 'জাস্টিস'-এর দাবি-কেউ ছিলেন জনরোষে, আরজি কর কাণ্ডে সেই মুখগুলি মনে আছে?

শহরের প্রাণকেন্দ্রে, সরকারি হাসপাতালের মধ্যে কর্মরত এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন করার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসটা। তারপর থেকেই নিহত নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের দাবিতে গর্জে উঠেছিল বাংলা তথা দেশ। বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন। কারা ছিলেন সেই আন্দোলনের মুখ? কাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল জনতা?

Advertisement
কারও 'জাস্টিস'-এর দাবি-কেউ ছিলেন জনরোষে, আরজি কর কাণ্ডে সেই মুখগুলি মনে আছে?আরজি করের ঘটনার মুখ
হাইলাইটস
  • আরজি করের ঘটনার বছর পার
  • কী অবস্থা দোষী সঞ্জয় রায়ের?
  • কারা ছিলেন সে সময়ে আন্দোলনের মুখ?

'জাস্টিস ফর আরজি কর...'। ঠিক একটা বছর আগে রাজ্য, দেশ, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশেও ধ্বনিত হয়েছিল এই স্লোগান। কর্মরত তরুণী চিকিৎসকের উপর কলকাতা শহরের প্রথমসারির সরকারি হাসপাতালের মধ্যে নৃশংস অত্যাচার নাড়িয়ে দিয়েছিল সকলকে। রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল মানুষের প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে। আট থেকে আশি গর্জে উঠেছিলেন ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে। আর সেই প্রতিবাদীদের মধ্যেই কিছু মুখ জনগণের মজ্জায় ঢুকে পড়েছিলেন। বিচারের লড়াইয়ে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন মুখ। আবার কয়েকজনের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ জন্মেছিল মানুষের। তাঁদের ভূমিকা নিয়ে চর্চা চলেছিল বিস্তর। ফিরে দেখা আরজি কর কাণ্ডের তেমনই কিছু ব্যক্তিত্বকে।

সঞ্জয় রায়
চিকিৎসক ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। পরে মামলার তদন্তভার যায় CBI-এর হাতে। গত বছর ১১ নভেম্বর চার্জশিটে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কেই দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তার ভিত্তিতে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারিতে সঞ্জয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় শিয়ালদা আদালত। সম্প্রতি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বেকসুর খালাসের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত সঞ্জয়। CBI-এর তরফেও সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে। সবকটি মামলারই শুনানি একসঙ্গে সেপ্টেম্বরে  হওয়ার কথা। প্রেসিডেন্সির ৬ নম্বর সেল এখন সঞ্জয়ের স্থায়ী ঠিকানা। জেলে তিনি বাগান পরিচর্যার কাজ করেন। দৈনিক মজুরি ৮০ টাকা। কলকাতা পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের বি১৪কে ব্যারাকে নীল-কালে বাইকে চেপে যাতায়াত করতে দেখা যেত এই সিভিক ভলান্টিয়ারকে। ৫৫/বি, শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের বাসিন্দা সঞ্জয় ৮ অগাস্ট রাতে আরজি করের সেমিনার রুমে গিয়েছিল। তার একটি ভাঙা ব্লু টুথ থেকে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে অপরাধ। 

আরজি কর আন্দোলন

অভয়ার বাবা-মা
'আপনাদের মেয়ে মনে হয় সুইসাইড করেছে...'। ৮ অগাস্ট রাতে এমন একটি ফোন পেয়েছিলেন নিহত তরুণীর বাবা-মা। রাতারাতি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল তাঁদের। প্রবীণ দম্পতি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন মেয়ের কর্মস্থলে। তবে তাঁদের কিছুতেই দেখতে দেওয়া হয়নি নিথর হয়ে পড়ে থাকা মেয়েকে। এক বছরে আমূল বদলে গিয়েছে এই প্রবীণ দম্পতির জীবন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারকে এখন রাজনীতি-প্রশাসনের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে মেয়ের ন্যায়বিচারের দাবিতে। তাঁদের অভিযোগ মূলত রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে। পুলিশ তাঁদের মেয়ের উপর হওয়া নৃশংসতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা অফার করেছিল বলে অভিযোগ করেন অভয়ার বাবা-মা। ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বলার অভিযোগও রয়েছে তাঁদের। CBI-এর তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়ে কখনও কলকাতা হাইকোর্ট তো কখনও দিল্লিতে সুপ্রিম কোর্টের দোরে দোরে ঘুরেছেন তাঁরা। দেখা করেছেন তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। চিঠি লিখেছেন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁদের মতে, বিচার এখনও অধরা। তাই বছর ঘুরলেও মেয়ের ন্যায়বিচারের দাবিতে আজও পথে নামতে প্রস্তুত এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। 

Advertisement

সন্দীপ ঘোষ
দুর্নীতি এবং তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে আরজি করের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে। তাঁর নির্দেশেই অভয়ার বাবা-মাকে আত্মহত্যার তত্ত্ব দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ। উঠেছিল আরজি করে থ্রেট কালচার চালানোর অভিযোগও। তাঁকে গ্রেফতার করে CBI। তাঁকে নিয়ে তৈরি বিতর্কের মধ্যেই ছুটি চেয়েছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ। স্বাস্থ্যভবনের তরফে সে সময়ে তড়িঘড়ি তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদে সোচ্চার হয় জুনিয়ার ডাক্তার থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে জামিন দেওয়া হলেও বর্তমানে দুর্নীতির মামলায় তিনি হাজতবাস করছেন। 

আরজি কর আন্দোলন

অভিজিৎ মণ্ডল
তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগে CBI-এর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। বর্তমানে জামিনে মুক্ত। আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার রুম এবং অন্যান্য সন্দেহজনক স্থান থেকে তথ্যলোপাটের অভিযোগ ওঠে। তার সঙ্গে অভিজিৎ মণ্ডল জড়িত বলে অভিযোগ। 

ডা. সুবর্ণ গোস্বামী
আরজি করের নির্যাতিতার যোনি থেকে ১ গ্রামও বীর্য মেলেনি বলেই জানানো হয়েছিল ফরেন্সিক রিপোর্টে। আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, ‘হাইমেনের ভিতর থেকে ১৫০ গ্রামের বেশি লিকুইড স্যাম্পল (তরল নমুনা) পাওয়া গিয়েছে। এটা হয়তো রক্তমাখা বীর্য।'  ওই মন্তব্য শোরগোল ফেলেছিল।সাধারণ ভাবে একটি পুরুষ শরীর থেকে প্রতি বার বীর্যপাতে ১.৫-৫ মিলিলিটার বীর্য নিঃসরণ হতে পারে। অর্থাৎ, ঘটনাস্থলে ১৫০ মিলিলিটার বীর্য পেতে ধর্ষকের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন হওয়া প্রয়োজন। শাসকদলের ঘনিষ্ঠেরা সমাজমাধ্যমে সুবর্ণকে ‘বিচিত্রবীর্য’ বলে কটাক্ষ করতে শুরু করেছিলেন। একাধিকবার তাঁকে বদলি করা হয় এই ঘটনার পর। 

আরজি কর আন্দোলন

ডা. কিঞ্জল নন্দ 
জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনে মুখ হয়ে উঠেছিলেন আরজি কর হাসপাতালের ছাত্র-চিকিৎসক এবং অভিনেতা কিঞ্জল নন্দ। ধরনা, আন্দোলন, রাত জাগা থেকে অনশন কর্মসূচি কিংবা লালবাজারে শিরদাঁড়া হাতে পৌঁছে যাওয়া। আন্দোলনে বরাবরই প্রথমসারির মুখ ছিলেন কিঞ্জল। পেশায় অভিনেতা হওয়ায় বারবার আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। বদলির মুখেও পড়তে হয়েছে এই জুনিয়র ডাক্তারকে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাজপথ, পেয়েছেন মানুষের সমর্থনও। 

ডা. অনিকেত মাহাতো
'বলতে দিলে তো বলব...'। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে বলে অভয়ার ন্যায়বিচার সহ জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তা এবং অন্যান্য দাবিদাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ডা. অনিকেত মাহাতো। আরজি করের নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের দাবিতে ধর্মতলায় আমরণ অনশনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালে। তারপর পোস্টিং নিয়েও বিতর্কের শিকার হয়েছিলেন। কাউন্সেলিংয়ে পছন্দসই স্থানে পোস্টিং পেলেও বাস্তবে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়। এরপরই কলকাতা হাইকোর্টেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন অনিকেত। 

ডা. দেবাশিস হালদার 
চেক শার্ট আর মুখ ভর্তি দাড়ি। দৃঢ়চেতা দেবাশিস হালদার আরজি কর আন্দোলনের প্রথমসারির মুখ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখার কারণেই। কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবন হোক কিংবা নবান্ন সভাঘর। ন্যায়বিচার সহ অন্যান্য দাবিদাওয়া নিয়ে বারবার প্রশ্ন করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। আন্দোলনেও দেখা যেত প্রথমসারিতে। সতীর্থদের সঙ্গে ছিলেন অনশন মঞ্চেও। 

Advertisement

ডা. আসফাকুল্লা নাইয়া
প্রতিবাদে গড়ে ওঠা জুনিয়ার চিকিৎসকদের আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন আসফাকুল্লা নাইয়া। বিভিন্ন মিছিলে-মিটিংয়ে তাঁর ঝাঁঝাল বক্তৃতা নজর কেড়েছিল। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে পিজিটি হয়ে ইএনটি সার্জেনের পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের শোকজ নোটিশও পান তিনি। পোস্টিং বিতর্কের কারণে তাঁকে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। তিনি অবশ্য বলেছিলেন, 'জানতাম এমন ধরনের ঘটনা ঘটবে। বরং না ঘটলে ভাবতাম আন্দোলন ঠিক মতো হয়নি।'

আরজি কর আন্দোলন

রিমঝিম সিনহা
'রাত দখলের' ডাক দিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছিলেন রিমঝিম সিনহা। ‘রিক্লেম দ্য নাইট' ক্যাম্পেন শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্সির এই প্রাক্তনী। গত বছর ১৪ এবং ১৫ অগস্টের সন্ধিক্ষণে রাত দখলে নেমেছিলেন কলকাতা থেকে জেলা, শহর থেকে মফসসলের মেয়েরা। সেই কর্মসূচির প্রথম আহ্বানটি ছিল রিমঝিমেরই। যে রাতের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ এবং ব্যাপ্তি কপালে ভাঁজ ফেলেছিল শাসকশিবিরের। এক বছরের মাথায় 'ঘুম নেই যে রাতে, জেগে থাকি প্রতিবাদে...' এই স্লোগানকে সামনে রেখে ফের রাজ্যজুড়ে রাত দখলের ডাক দেওয়া হয়েছে। 

বিনীত গোয়েল 
কলকাতার তৎকালীন নগরপালস বিনীত গোয়েলের অপসারণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। আন্দোলনের চাপে তাঁদের দাবি মেনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বদলি করেন বিনীত গোয়েলকে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত মহিলা চিকিৎসকের উপর নৃশংস অত্যাচার ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ অথচ কোনও ভূমিকা নেই কমিশনারের, এমনই অভিযোগ ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের। IPS বিনীত গোয়েলের বিরুদ্ধে আরজি করের নির্যাতিতার পরিচয় সামনে আনার অভিযোগে মামলা হয়। পরবর্তীতে আদালতের কাছে ক্ষমা চান তিনি। 

নারায়ণস্বরূপ নিগম 
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের গ্রেফতারির দাবি তুলেছিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁর বিরুদ্ধে দুনীর্তি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ করেন ডাক্তাররা। তাঁকে অপসারণের দাবিও মেনে নেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্মবিরতিতে অনড় জুনিয়র ডাক্তারদের একাধিকবার কাজে ফেরার আর্জি জানিয়েছিলেন নারায়ণস্বরূপ নিগম। 
 

 

POST A COMMENT
Advertisement