অবশেষে পুলিশের জালে সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা শাহজাহান শেখ। গত ৫৫ দিন ধরে পলাতক ছিল। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, মহিলাদের উপর যৌন হেনস্থা-সহ একাধিক অভিযোগ করেছেন সন্দেশখালির মহিলারা। অথচ এই শাহজাহান বাংলাদেশ থেকে এসে এই সন্দেশখালিতে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে বলে খবর। সন্দেশখালিতে সে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করত। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যে শাহজাহান ডন হয়ে ওঠে এলাকার।
শাহজাহানের উপর কেন পদক্ষেপ ইডি-র? এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের দাবি, পশ্চিমবঙ্গের রেশন বন্টন কেলেঙ্কারিতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই মামলায় প্রথম গ্রেফতার হন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখ এবং বনগাঁ পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্যরও সেই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে ৫ জানুয়ারি ইডি-র টিম শাহজাহান শেখের বাড়িতে অভিযান চালায়। ইডি আধিকারিকদের উপর হামলা চালায় শাহজাহানের বাহিনী। সেদিন সাংবাদিকদের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। ভাঙচুর করা হয় ইডি আধিকারিকদের গাড়িও।
এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তিনটি আলাদা FIR নথিভুক্ত করা হয়। এই অভিযোগগুলির মধ্যে একটি করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আক্রান্ত ইডি-র আধিকারিকদের তরফে জানানো হয়, তাঁদের তিনজন অফিসার আহত হয়েছেন। সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও মানিব্যাগ লুট করা হয়।
শাহজাহান শেখকে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। রেশন দুর্নীতি মামলায় শঙ্কর আঢ্য গ্রেফতারও হয়। বনগাঁর সিমুলটোলা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে দাবি করা হয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে দুবাইয়ে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ। ইডির অভিযোগ, শঙ্কর আঢ্যর কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে খবর, শাহজাহান শেখ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসে। চার ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাই শাহজাহানের এখনও সেখানে একটি বাড়ি রয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা। সেই কারণেই শাহজাহান সেখানে বসবাস শুরু করে। প্রথমে সে ইটের ভাটায় কাজ করত। গাড়ির চালক হিসেবেও কাজ করেছে। রাজ্যে তখন বাম শাসন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ২০০২ সালে শাহজাহান ইটভাটা শ্রমিকদের একটি ইউনিয়ন গঠন করে তার নেতা হন। ইউনিয়ন নেতা হওয়ায় এলাকায় তার সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং সিপিআই(এম)-এর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে সে।
২০০৪ সালে, শাহজাহান রাজনীতিতে প্রবেশ করে। শোনা যায়, সিপিআইএম পার্টিতে যোগ দেওয়ার পরই স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর অত্যাচার শুরু করে শাহাজাহান। সে এলাকা দখল করতে শুরু করে। চাষযোগ্য উর্বর জমি কেড়ে নিয়ে ভেড়িতে পরিণত করে। তবে শাহাজাহানের এই জোর-জবরদস্তি অনেকেই মানতে চাননি। যেসব কৃষক তাকে জমি ইজারা দিতে রাজি হননি, তাঁদের উপর অত্যাচার করতে শুরু করে শাহাজাহান। এভাবে ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে শাহাজাহান। ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়। শাহাজাহানও তৃণমূলে যোগ দেয়।
এবাবে তৃণমূলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে শাহজাহানের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের খাস লোক হয়ে ওঠে সে। গত বছর জেলা পরিষদের আসনে জিতে তৃণমূলে আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে শাহাজাহান। প্রাথমিকভাবে খবর, শাহজাহানের ১৭টি গাড়ি, ৪৩ বিঘা জমি, প্রায় ২ কোটি টাকার গয়না এবং প্রায় ২ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রয়েছে। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, শাহজাহানের সম্পত্তি আরও অনেক বেশি। তার কাছের লোক শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দার শাহজাহানের সব কাজ দেখভাল করে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্তমানে তৃণমূলের সন্দেশখালী ইউনিটের সভাপতি এই শাহাজাহান। তাঁর প্রভাব-ক্ষমতা নাকি এলাকার যে কোনও সাংসদ বা বিধায়কের চেয়ে বেশি। এলাকায় 'ভাইজান' নামেও ডাকা হয় তাঁকে। জানা গেছে, ২০০০ সাল পর্যন্ত শাহজাহান কখনও কন্ডাক্টরের কাজ করতেন আবার কখনও সবজি বিক্রি করতেন। মাঝে মাঝে ট্রেকার ড্রাইভার হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য জমা দেওয়া হলফনামায় শিক্ষার কলামটি খালি রেখেছিলেন শাহজাহান।