আরজি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের পর নারী সুরক্ষা সংক্রান্ত নতুন বিল পাশ করেছে রাজ্য সরকার। এই বিলে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ সংক্রান্ত মামলায় যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের সব অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। 'অপরাজিতা নারী ও শিশু (ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২৪' নামের এই বিলটি আইনে পরিণত হলে তা সারা বাংলায় কার্যকর হবে।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধকে জামিন অযোগ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের নতুন বিলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS),ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সমংহিতা (BNSS) এবং POCSO আইন সংশোধন করা হয়েছে।
এই বিলে ধর্ষণ ও গণধর্ষণে দোষী সকলের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। সেখানে আরও উল্লেখ, পুলিশকে ২১ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। সময়মতো তদন্ত শেষ না হলে আরও ১৫ দিনের সময় চাওয়া যেতে পারে আদালতের কাছে। তবে বিলম্বের কারণও আদালতকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে নারী ও শিশুসহ যৌন অপরাধের মামলায় চার্জশিট দাখিলের এক মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
যদিও বিলটি শুধুমাত্র বিধানসভায় পাশ হয়েছে। তা আইনে পরিণত করতে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন। এই প্রথম নয়, নারীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আগেও হয়েছে। ধর্ষকদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার জন্য আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে আইনে পরিবর্তন হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখনও দেশে প্রতিদিন ৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
নির্ভয়া মামলার পর ধর্ষকদের সাজা
১৬ ডিসেম্বর ২০১২। দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাসে একজন তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয়। পরে সেই তরুণী মারা যান। ঘটনার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। আইনেও পরিবর্তন আনা হয়। বদলে যায় ধর্ষণের সংজ্ঞাও। আগে শুধু বলপ্রয়োগ বা মতবিরোধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে ধর্ষণের আওতায় আনা হত। কিন্তু ২০১৩ সালে আইন সংশোধন করে এর পরিধি বাড়ানো হয়। একে 'নির্ভয়া আইন'ও বলা হয়।
তখন POCSO আইনেও পরিবর্তন করা হয়। নয়া আইনে বলা হয়, অসামীর বয়স ১৬ বা ১৮ হলে তার অপরাধের ধরন দেখে তাকে প্রাপ্তবয়স্কের মতোই বিবেচনা করা হবে। এই সংশোধন করা হয়েছিল কারণ নির্ভয়াকাণ্ডের ৬ আসামীর মধ্যে একজন নাবালক ছিল। তাকে তিন বছরের মধ্যে মুক্তিও দেওয়া হয়। নয়া আইনে ধর্ষণ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। ধর্ষণের পর নির্যাতিতা মারা গেলে বা কোমায় চলে গেলে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তবে এত কিছুর পরও অপরাধের সংখ্যা কমেনি। পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলছে। ২০১২ সালের আগে প্রতি বছর গড়ে ২৫ হাজার ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হতো। কিন্তু এরপর সেই সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। শুধু ২০১৩ সালে ৩৩ হাজারের বেশি মামলা নথিভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৯ হাজারের কাছাকাছি।
আবার ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর হায়দরাবাদে ২৭ বছর বয়সী এক তরুণীকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। ঘটনায় চার অপরাধীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে চারজনই এনকাউন্টারে মারা যায়। চারজনই পুলিশের হেফাজত থেকে পালানোর চেষ্টা করে। এই ঘটনার পর তেলেঙ্গানা সরকার ফৌজদারি আইন সংশোধন করে। নয়া বিলও আনে। তবে সেই বিল এখনও আইনে পরিণত হয়নি। তা এখনও আইনে পরিণত হয়নি।
ধর্ষণে সাজার হার কম
ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে মাত্র ২৭টিতে আসামি দোষী প্রমাণিত হয়। বাকি মামলায় আসামীরা খালাস পেয়ে যায়। ২০২২ সালে সারাদেশে প্রায় দুই লাখ ধর্ষণের মামলা বিচারাধীন ছিল। ২০২২ সালে মাত্র সাড়ে ১৮ হাজার মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। যেসব মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার মামলায় অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। যেখানে ১২ হাজারের বেশি মামলায় অভিযুক্ত খালাস পেয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও ২৪ বছরে মাত্র পাঁচ ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ২০০৪ সালে ১৯৯০ সালের ধর্ষণ মামলায় ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসি হয়। আর ২০২০ সালের মার্চ মাসে চারজনের ফাঁসি হয়।
কোন সাজার কী শাস্তি?
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি ১২ বছরের কম বয়সী কোনও মেয়েকে ধর্ষণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয় তবে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি হতে পারে। আসামী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার কারাদণ্ডের সাজা বহাল থাকতে পারে। এই ধরনের মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। এ ছাড়াও জরিমানা হবে। গণধর্ষণ মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে।
এছাড়াও, নাবালিকাদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে ২০১২ সালে POCSO আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না। তবে ২০১৯ সালে তা সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও আনা হয়। এই আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান থাকলে আসামিকে সারাজীবন কারাগারে কাটাতে হবে।