যে আন্দোলনে সওয়ার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাম শাসন উত্খাত করে ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই ঘটনা থেকেই হাত ধুয়ে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিলিগুড়িতে দাবি করলেন, 'টাটাদের আমি তাড়াইনি। সিপিএম তাড়িয়েছে।' তাঁর বক্তব্য, তিনি কৃষকদের জমি ফেরানোর জন্য শুধু আন্দোলন করেছিলেন। ন্যানো প্রকল্প বিদায়ের সব দায় সিপিএম-এর উপরেই চাপিয়ে দিলেন মমতা।
সিপিএমকে খোঁচা দিয়ে বলেন, 'কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছে, টাটা কেন বাংলার ছেলেমেয়েদের চাকরি দেবে? বিজেপি-সিপিএম এ সব বলে বেড়াচ্ছে। আমরা বিভেদ করি না। এ টু জেড যাঁরা আসবেন শিল্প করতে, আমরা বিভেদ করি না। টাটা স্টিলের চাকরি, প্রশিক্ষণ দিতেই পারে। ওরা জানেই না টাটার কতগুলি সংস্থা রয়েছে এখানে।'
মমতার টাটা তাড়ানো মন্তব্যের পরেই তীব্র কটাক্ষ শুরু করেছে। সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী মমতাকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, 'মিথ্যায় একেবারে ডিলিট করেছেন, ঘটনাক্রমে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। উনি যেটা বলেননি এখনও, তা হল, সিঙ্গুর থেকে টাটাকে তাড়ানোর জন্য ধর্নায় বসেছিলেন বুদ্ধবাবুই। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ করে দেন, যাতে কোনও ভাবেই সিঙ্গুরে কারখানা গড়তে না পারে টাটা। তার জন্য বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে রাজ্যের বামপন্থীরা, সাধারণ মানুষ ভাঙচুর চালান।'
টাটাদের তাড়িয়েছিল কে?
মমতার এই দাবি সত্যি না মিথ্যে, তা জানতে “Singur Movement:The full story – The struggle of Ma, Mati, Manush” বইটির সাহায্য নেওয়া গেল। কী লেখা রয়েছে বইতে?
#টাটা মোটরসের কারখানার জন্য সিঙ্গুরের মানুষের জমি জোর করে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বাম সরকার সিঙ্গুরে প্রায় ১ হাজার একর জমি টাটা মোটরস-এর ছোটগাড়ির কারখানার জন্য অধিগ্রহণ করেন।
#তৃণমূলের দাবি অনুযায়ী, ২০০৬ সালের ১৮ মে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক ভাবে সিঙ্গুর প্রকল্পের বিষয়ে ঘোষণা করে টাটা গোষ্ঠী। এরপরেই সিঙ্গুরের মানুষ আন্দোলন শুরু করে দেয়। ২০০৬ সালের ২৫ মে টাটা মোটরস-এর প্রতিনিধিরা জমি পরিদর্শনের জন্য সিঙ্গুর যান। স্থানীয়রা টাটা প্রতিনিধিদের ব্যাপক বিক্ষোভ দেখান। জমির বদলে চাকরি চাই, দাবি শুরু হয়।
#২০০৬ সালের ১৭ জুলাই কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তত্কালীন তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কৃষকরা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেই আন্দোলনে আরও মানুষ দেন। ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই তাঁরা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করেন। ২২ অগাস্ট স্থানীয় বিডিও অফিসও ঘেরাও করেন তাঁরা।
#২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে প্রকল্পকে ঘিরে স্থানীয় গ্রামের মানুষ ও প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কৃষক ও অন্যান্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য তৃণমূল নেতারা ধর্নায় বসেন। গভীর রাতে র্যাফ ও পুলিশ ওই ধর্নায় আক্রমণ করে। রাজ্য সরকারে আদেশেই নাকি, ধর্না তোলার জন্য পুলিশ বলপ্রয়োগ করে। ৭৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
#এর পর থেকেই সিঙ্গুর আন্দোলনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা বাড়তে শুরু করে। ২০০৬ সালের ৯ অক্টোবর সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে হরতালের ঘোষণা করেন। দাবি ছিল, টাটা তাদের প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও করুক। কংগ্রেস সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থনও জুটে যায়। এরই মধ্যে সংঘর্ষে প্রথম মৃত্যুর খবর আসে।
# ২০০৬-এর ৩০ নভেম্বর সিঙ্গুরে গিয়ে আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা। সেই অশান্তির রেশ এসে পৌঁছয় রাজ্য বিধানসভায়। সে দিন বিরোধী দল তৃণমূলের বিধায়কদের একাংশ বিধানসভার আসবাব ভাঙচুর করেছিলেন বলে বামেদের অভিযোগ।
# সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরানোর দাবিতে ২৬ দিন (৩-২৮ ডিসেম্বর, ২০০৬) ধর্মতলার মোড়ে অনশন-অবস্থান করেছিলেন মমতা। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর তৎপরতায় রাজভবনে আলোচনা হয়েছিল সেই ঘটনা নিয়ে। মমতার অনশন মঞ্চে এসেছিলেন বিভিন্ন দলের নেতা। সমর্থন এসেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও। অনশন মঞ্চে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে অনশন প্রত্যাহার করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী।
#মে মাসে সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প রূপায়ণের পথ সুগম করতে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। কিন্তু তা সফল হয়নি।
#২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে গাড়ি প্রদর্শনীতে আত্মপ্রকাশ করে টাটা ন্যানো। ১৮ জানুয়ারি জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রাজ্যের পক্ষে রায় দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
#এর আগে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ২০ অগস্ট বুদ্ধদেবের সঙ্গে মমতার আলোচনায় মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। রাজভবন জানায়, ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি না নিতে সরকার সম্মত। কিন্তু সরকার বাড়তি ক্ষতিপূরণের কথাও ঘোষণা করে।
#ন্যানো কারখানা রাজ্যের বাইরে সরানোর হুঁশিয়ারি রতন টাটার। ৩ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে কারখানা নির্মাণের কাজ স্থগিত করে টাটা মোটরস। পাশাপাশিই অন্য রাজ্যে জমির খোঁজ শুরু করে তারা।
#৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প সরানোর ঘোষণা করেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়, ন্যানো কারখানার পরবর্তী গন্তব্য নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতের সানন্দে। তখন মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।