প্রৌঢ় বয়সে সম্পর্কে ইতি টেনেছিলেন মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এবং তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসও ২৬ বছরের দাম্পত্যে ইতি টেনেছিলেন ৫৫ বছর বয়সে। হলিউড অভিনেতা হিউ জ্যাকম্যান, টম ক্রুজ়, ব্র্যাড পিট— সবাই এক অর্থে গ্রে ডিভোর্সি। সেই সময় থেকেই ‘গ্রে ডিভোর্স’-এর চর্চা শুরু হয়। আমেরিকায় এই ‘গ্রে ডিভোর্স’-এর সংখ্যা বেশি হলেও এখন ভারতেও ট্রেন্ড বাড়ছে। বলিউডের এমন অনেক তারকা দম্পতি রয়েছেন, যাঁরা এই ‘গ্রে ডিভোর্স’র পথে হেঁটেছেন। সম্প্রতি অভিষেক বচ্চন ও ঐশ্বর্য রাইয়ের ডিভোর্স চর্চা নিয়েও যখন আলোচনা তুঙ্গে, তখনও শোনা যাচ্ছিল, এই দম্পতি নাকি ‘গ্রে ডিভোর্স’র পথে হাঁটতে চলেছেন। কিছুদিন আগেই অস্কারজয়ী সুরকার এআর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সায়রা বানু দীর্ঘ ২৯ বছরের দাম্পত্য জীবন ইতি টানার ঘোষণা করেছেন। সুরকার এখন ৫৭। তাঁর স্ত্রী সায়রা বানু সবে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। তাঁদের বিচ্ছেদের ঘোষণায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে ‘গ্রে ডিভোর্স’ নিয়ে। আসলে সুখী দাম্পত্যে প্রেম যদি রঙিন হয় তাহলে বিচ্ছেদের রং ধূসর বা গ্রে হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কিন্তু এই ‘গ্রে ডিভোর্স’ আসলে ঠিক কী? অনেকের কাছেই বিষয়টি খুব অস্পষ্ট। bangla.aajtak.in-কে এই ডিভোর্স সম্পর্কে ব্যাখা দিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুকুল বিশ্বাস।
এই বিষয়ে আইনজীবী বলেন, দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন পেরিয়ে আসা স্বামী-স্ত্রীর চুলে যখন ধূসর রং ধরতে শুরু করেছে, যখন তাঁরা পঞ্চাশের আশপাশ বা তারও বেশি, তখন যদি তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বিচ্ছেদের পথে হাঁটবেন, যে যার ভবিষ্যৎ নিজের মতো বুঝে নেবেন, চুলে পাক ধরা সেই দুই ‘পরিণতবয়সি’র বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্তই হল ‘গ্রে ডিভোর্স’। তবে গ্রে ডিভোর্স বলে আইনে আলাদা করে কোনও টার্মস নেই। আইনে কিন্তু ডিভোর্স মানে হচ্ছে ডিভোর্স। ‘গ্রে ডিভোর্স’ বলে আইনে কোনও প্রভিশন নেই। কিন্তু আমরা ‘গ্রে ডিভোর্স’ বলতে যেটা বোঝাই সেটা হচ্ছে যে ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে যে সব বিবাহিত দম্পতিরা বিবাহ বিচ্ছেদ করছেন, তাঁদের সেই ডিভোর্সটাকে ‘গ্রে ডিভোর্স’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু আইনে আলাদা করে এই ‘গ্রে ডিভোর্স’ বলে কিছু নেই, ডিভোর্সের যা যা নিয়ম আইনে আছে সেটাই ‘গ্রে ডিভোর্স’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেকেই আবার এই ‘গ্রে ডিভোর্স’কে ধূসর বিবাহ বিচ্ছেদ বলে থাকে।
কেন বলা হচ্ছে গ্রে ডিভোর্স বা ধূসর বিবাহ বিচ্ছেদ? মুকুল বিশ্বাস বলেন, এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ৫০ বছরের পর নারী-পুরুষ উভয়েরই চুল-দাড়িতে পাক ধরে, তাঁদের জীবনটা অনেকটা মলীন হয়ে আসে তাই সেক্ষেত্রে এটাকে ‘গ্রে ডিভোর্স’ নাম দেওয়া হয়েছে। আইনতভাবে ডিভোর্সের জন্য যা যা করতে হয় সেটাই ‘গ্রে ডিভোর্স’-র ক্ষেত্রেও একই নিয়ম-নীতি। কেউ যদি ৫০, ৬০ বা ৭০ বছর বয়সে এসে মনে করেন ডিভোর্স করবেন তাহলে তাঁকে ডিভোর্সের প্রসিডিউরে যেতে হবে, আমাদের যেটা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অথবা হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে যেরকমভাবে বলা আছে সেই অনুযায়ী হবে। কিন্তু ‘গ্রে ডিভোর্স’ বলে আলাদা করে কোনও টার্ম বা শব্দ আইনে নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বলেন, সম্প্রতি এটার চল বাড়লেও ১৯৯০ সাল থেকে কম-বেশি এই ‘গ্রে ডিভোর্স’ হত কিন্তু এখন এটা বেড়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে ৬৫-৭০ বছরে এসেও দম্পতিরা ডিভোর্স করছে। বিল গেটসও শেষ বয়সে এসে ডিভোর্স নেন, এটাও ‘গ্রে ডিভোর্স’র মধ্যেই পড়ছে। এখন প্রশ্ন হল কেন বাড়ছে গ্রে ডিভোর্স? এ প্রসঙ্গে আইনজীবী বলেন, যদি এই ভারতের কথা ধরা হয়, আগে মানুষ বিবাহ মানে ভাবত যে সাত জন্মের বন্ধন বা সারাজীবনের মতো একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকা। সমাজের এই ধারণাটা সেটা এখন অনেকটাই বদলেছে এবং এই চিরাচরিত বিশ্বাস থেকে বেরিয়েও এসেছে সমাজ। আমার ওপর কেউ যদি রোজ শারীরিক অত্যাচার করে সেটা সহ্য করে অথবা কারোর সঙ্গে যদি আমার মানসিক বনিবনা না হয়, আমি যদি সুখে-শান্তিতে সংসার না করতে পারি, তাহলে এই যে লাইফটাইম এনগেজমেন্ট-এর এই যে ধারণা, সমাজ কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, সমাজ কিন্তু এই ডিভোর্সটাকে মেনে নিচ্ছে। আগেও দেখা গিয়েছে যে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ হলে একটা মেয়ের ওপর যে দায় আসত, সমাজ সেই মেয়েটিকে বাঁকা চোখে দেখত, এখন কিন্তু আমাদের সমাজ সেই বিষয়টা থেকে ওভারকাম করে উঠতে পেরেছে। তিনি আরও জানান, এখন আমাদের ভারতীয় সমাজ বিচ্ছেদটাকে খুব ভালভাবে মেনে নেয়। দ্বিতীয় কারণ হল, মহিলাদের স্বনির্ভরতা। আগের থেকে এখনকার মহিলারা অনেক বেশি স্বনির্ভর এবং আর্থিকভাবে সাবলম্বী। মহিলাদের এখন আর পুরুষের মুখাপেক্ষী থাকা, তাঁদের ওর নির্ভর করে থাকার বিষয়টি নেই। ‘গ্রে ডিভোর্স’র আরও একটি কারণ হল, অনেক মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের বাইরে পড়াশোনা করতে বা চাকরি করতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী একা হয়ে পড়ছেন আর কোনও ঝগড়া-ঝামেলা হলে তাঁদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আসলে একটা সন্তানকে ঘিরেও কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ডিং তৈরি হয়। সেই বন্ডিংটাও কিন্তু দিন দিন আলগা হয়ে গিয়েছে।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এই ‘গ্রে ডিভোর্স’র কিছু অসুবিধার কথাও তুলে ধরেছেন, যা পরপর দেওয়া হল।
১) বেশি বয়সে ডিভোর্স হলে যেটা প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে যে উভয় পক্ষের সম্পত্তি ভাগাভাগিটা যেন সঠিকভাবে হয়।
২) স্বামী বা স্ত্রী তাঁদের সম্পত্তি যদি উইল করে যেতে চান, তাঁদের সন্তানকে দেওয়ার জন্য, সেটা বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৩) গ্রে ডিভোর্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বয়সকালে কোর্ট-কাছারিতে দৌঁড়ঝাঁপ করা। কারণ এই ‘গ্রে ডিভোর্স’-এও কিন্তু সঠিক ডিভোর্সের আইন মেনেই বিচ্ছেদ করতে হবে।
৪) আর্থিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যখন একসঙ্গে থাকছেন তাঁরা, তখন দুজনের মিলিত উপার্জনে সংসার চলছে। কিন্তু যখনই তাঁরা ডিভোর্সের মধ্যে ঢুকে পড়ছে তখনই তাঁদের আয়টা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তাই সঞ্চয়টা কিন্তু সঠিকভাবে রাখতে হবে। কারণ ‘গ্রে ডিভোর্স’-এ আর্থিক সুরক্ষাটা অনেকটাই কমে যায়। এই সময় আর্থিকভাবে নিরাপত্তার অভাব দেখা যায়।
৫) শেষ বয়সে এসে ডিভোর্সের পর নতুন করে জীবন শুরু করাটাও সমস্যার। ২৫, ৩০ বা ৩৫-এ এসে ডিভোর্স হলে নতুন করে জীবন শুরু করার সম্ভাবনাটা থাকে, কিন্তু ৫০ বছরের পর ডিভোর্স হলে সেই সম্ভাবনা খুবই কম। পারস্পরিক সাহচর্য বা শেষ বয়সে একে-অপরের দেখভাল করার বিষয়টাও কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাহত হবে।
তাই এইসব দিকগুলো ভাল করে বিচার বিবেচনা করে তবেই ‘গ্রে ডিভোর্স’র সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আইন মনে করে বলে জানান আইনজীবী। প্রসঙ্গত, গ্রে ডিভোর্সের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে আমেরিকায়। তবে এখন ভারতেও এর সংখ্যা বাড়তে এখন দেখা যাচ্ছে। বিয়ে নিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির যে চিরাচরিত ধারণা ছিল সেখান থেকে মহিলারা এখন বেড়িয়ে এসেছে। তাই গ্রে ডিভোর্সের ট্রেন্ডটা বাড়ছে। কারণ সমাজ এখন বিচ্ছেদটাকে মেনে নিয়েছে।