জাপান শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোলাপি চেরি ব্লসম, সবুজ গন্ধওয়ালা ম্যাচা চা, রঙিন কিমোনো, হালকা দার্শনিকতা মেশানো ‘ইকিগাই’—আর হ্যাঁ, টিভির পুরনো বন্ধুর মতো টেকেশির ক্যাসলও মনে পড়ে! কিন্তু জাপান মানেই কি কেবল এসব? একদমই নয়। একটা মুহূর্তে আপনি ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হওয়া ম্যাচা লাটে খাচ্ছেন, আর পরমুহূর্তেই হয়তো প্রাচীন কোনও মন্দিরে ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। আর যদি আপনি হন খাঁটি ‘ফুডি’, তাহলে তো আর কথাই নেই—সুশি, র্যামেন, উডন, তেম্পুরা... একেকটা খাবার মানে একেকটা নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু ধরুন কেউ বলল, "আমি জাপান যাচ্ছি লাভ হোটেল ঘুরতে!"... শুনেই চমকে উঠলেন তো?
হ্যাঁ, ভারতীয়দের কাছে ব্যাপারটা একটু ‘রিস্ক’ ঠেকতে পারে, কিন্তু জাপানে লাভ হোটেল কোনও ট্যাবু নয়—বরং এক দারুণ মজার সাংস্কৃতিক কৌতূহল। শিবুয়া বা ওসাকার রঙিন অলিগলিতে, নিয়ন আলোয় ঝলমলাতে থাকা এই হোটেলগুলো যতটা গোপন, ঠিক ততটাই রঙচঙে।
আসলে নামেই তো সব বলা হয়ে গেছে—‘লাভ’ আর ‘হোটেল’। সহজ কথায়, এগুলো এমন হোটেল যেখানে আপনি ঘণ্টাচুক্তিতে বা রাতভর থাকতে পারেন, একান্তে। কারও চোখে চোখ রেখে, লোকলজ্জা বা সমাজের মানা না মাথায় নিয়ে। কেউ কাউকে প্রশ্ন করে না, রিসেপশনে কাঁধ ঝাঁকানো কেউ নেই, বেশিরভাগ সময় অটোমেটেড সিস্টেমে চেক-ইন আর চেকআউট।
এবং বিশ্বাস করুন, এই হোটেলগুলোর ঘর দেখলে চোখ কপালে উঠবে। কেউ চায় রাজপ্রাসাদ, কেউ চায় স্পেসশিপ, কেউ আবার ‘হেলো কিটি’ স্টাইলে বাঁধা থাকার ঘর—সবই মেলে এখানে! হাসপাতাল থিম, অ্যাকোয়ারিয়াম ঘর, জেল সেল থিম, এমনকি এমন ঘরও আছে যেখানে মনে হবে আপনি সমুদ্রের নীচে রয়েছেন।
ভেবেন না এসব আধুনিক ইউটিউব ট্রেন্ড। লাভ হোটেলের শিকড় কিন্তু বহু পুরনো, প্রায় ১৬শ শতকের জাপানে। সেই সময় পাবলিকলি প্রেম দেখানো খুব একটা ‘সুন্দর’ ব্যাপার ছিল না। তাই প্রেমিক-প্রেমিকারা গোপনে মেলামেশার জন্য খুঁজে নিয়েছিল এক বিকল্প পথ।
তখন তৈরি হয় ‘চা ঘর’, যেখানে সমাজের চোখ এড়িয়ে দু’জনে সময় কাটাতে পারতেন। এরপর সময় বদলেছে, সমাজ একটু আধটু খোলামেলা হয়েছে, আর সেই চা ঘর পেয়েছে নিয়নের আলো আর ঘরের ভিতরে রোল প্লে-র ছোঁয়া—ব্যস, লাভ হোটেল এসে হাজির।
অনেকেই ভাবেন, এসব হোটেল শুধু দম্পতিরাই যান। কিন্তু বাস্তবে, অনেক সময় ক্লান্ত মানুষ একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্যও যান এখানে। আবার কেউ কেউ যান শুধু সেই অদ্ভুত থিমড ঘরগুলো দেখতেই। আপনি চাইলেও যেতে পারেন শুধুমাত্র ইনস্টাগ্রাম রিল বানাতে।
অনেক হোটেলে এখন ছোট ছোট ঝরনা, প্রাইভেট জাকুজি, কারাওকে রুম—সবই মেলে। দামও খুব বেশি নয়। ঘণ্টা দুয়েকের ‘রেস্ট’ ১৫০০-২০০০ ইয়েনেই পাওয়া যায় (মানে ভারতীয় টাকায় প্রায় হাজার-বারোশো টাকা)।
আর সবার বড় কথা—এই হোটেলগুলো কোনওরকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াই চলে। লজ্জা নেই, সমাজের চোখ নেই—একটা খোলামেলা অথচ নিরাপদ পরিসর।
এখন যদি ভারতীয় চোখে দেখি, তাহলে এমন হোটেলের ভাবনা শুনেই হয়তো কেউ কেউ মুখ ঘুরিয়ে নেবেন। কিন্তু জাপানে এগুলো কোনও লুকোচুরি নয়, বরং সমাজের বাস্তবের এক মজাদার রূপ। চিন্তা করে দেখুন, যদি এমন একটা জায়গা থাকে যেখানে আপনি নিজের মতো থাকতে পারেন, খোলামেলা থাকতে পারেন, কেউ কোনো প্রশ্ন করছে না—তাহলে সেটাকে কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
লাভ হোটেলে যে কোনও কাপল ইচ্ছে মতো রুম ভাড়া করে ভালোবাসায় মাততে পারেন।