১৯৯৯ সাল থেকে একবারের জন্যও হারেননি, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে হারতে হয়েছে অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে। আর এই একবার পরাজয়ের কারণে মূল্য চোকাতে হচ্ছে তাঁকে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে লোকসভায় কংগ্রেসের নেতাও করা হয়েছিল এবং ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাঁকে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে পাঠানো হয়েছিল। এরপর থেকে তিনি উভয় দায়িত্ব পালন করছিলেন। যদিও এবার মনে হচ্ছে অধীর কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছেন। যেভাবে তাঁকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে সরানো হয়েছে তাতে অধীর যে ক্ষুব্ধ তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ যে তিনি প্রকাশ্যে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অধীর রঞ্জন চৌধুরী শুরু থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কট্টর বিরোধী। আর সেটাই অধীরের পদ হারানোর মূল কারণ বলেও মনে করা হচ্ছে। অধীরের ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, 'মনে হচ্ছে অধীর রঞ্জন চৌধুরী কংগ্রেস থেকে সাসপেন্ড হতে চান। তিনি নিজেই উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি হয়ত ইতিমধ্যেই বিজেপির সঙ্গে কথা বলেছেন।'
সুযোগ দেখে এনডিএ-র দলিত নেতা রামদাস আঠাওয়ালে বলেছেন, 'আমি অধীর রঞ্জন জিকে অনুরোধ করছি... যদি কংগ্রেসে তাঁকে অপমান করা হয়, তাহলে তাঁর কংগ্রেস ছেড়ে দেওয়া উচিত... আমি তাঁকে এনডিএ বা আমার দল আরপিআই-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।'
এটা একপ্রকার পরিষ্কার যে অধীর রঞ্জন চৌধুরীর কেরিয়ার বর্তমানে খুব কঠিন পর্যায় দিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন খুব দরকার রাহুল গান্ধীর, কিন্তু তিনি বাংলায় নিজের স্বার্থে টিএমসি-র বিরুদ্ধে লড়ছিলেন না, নিজের ইচ্ছাতেও লড়ছিলেন না। তাই অধীর রঞ্জন কি রাহুল গান্ধীর ইচ্ছা ছাড়া কিছু করতে পারতেন? সর্বোপরি, অধীর রঞ্জনের ওপর আস্থা ছিল রাহুলের, সেই কারণেই তাঁকে লোকসভায় নেতা করা হয়েছিল এবং তারপরে তাঁর হাতেই বাংলার নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল। অধীর রঞ্জনের মতে, তাঁকে প্রদেশ কংগ্রেসের একটি মিটিং ডাকতে বলা হয়েছিল। সেই মিটিংয়ে যা ঘটেছিল, যা তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। অধীর রঞ্জন বলেন, 'আমি জানতাম আমার সভাপতিত্বে বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই সময় পর্যন্ত আমি সভাপতি ছিলাম, কিন্তু সভার শুরুতে যখন গোলাম আহমেদ মীর ভাষণ দিচ্ছিলেন, তিনি আমাকে প্রাক্তন সভাপতি বলে সম্বোধন করেছিলেন। তখনই আমি জানতে পারি যে আমি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি হয়েছি।' কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আহমেদ মীর পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস ইনচার্জ।
লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ে খুব ক্ষুব্ধ অধীর রঞ্জন চৌধুরী
কংগ্রেসে অধীর রঞ্জনের অবস্থা বিজেপিতে স্মৃতি ইরানির মতোই। নির্বাচনের ফল আসতেই তিনি বলতে শুরু করেন, 'এখন আমার বাংলোও হারিয়ে যাবে। অধীর রঞ্জন বলেন, 'আমার মেয়ে পড়াশোনা করছে। সে মাঝে মাঝে এই জায়গাটা তার পড়াশোনার জন্য ব্যবহার করে। আমাকে এখন সেখানে একটা নতুন বাড়ি খুঁজতে হবে। কারণ আমার কোনও বাড়ি নেই। তখনই আমি বলেছিলাম, আমি নিজেকে একজন বিপিএল এমপি বলি। রাজনীতি ছাড়া আমার আর কোনও দক্ষতা নেই। আমার অসুবিধা হবে এবং আমি জানি না কীভাবে সেগুলো কাটিয়ে উঠব।' আমরা যদি দেখি, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের পরাজয়ের জন্য অধীর রঞ্জনকেই দায়ী করা হয়েছে। পরে, তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে অধীর রঞ্জন চৌধুরীর কারণেই পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়া জোট ভেঙেছে। আসলে অধীর রঞ্জন চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আপস করবেন না বলে অনড় ছিলেন। আসলে, তিনি এমনও বলেছিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যদি কোনও সমঝোতা করতে হয় তবে বাংলায় কংগ্রেসের নেতৃত্ব তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে দেওয়া উচিত।
পরাজয়ের জন্য অবশ্যই দুঃখ আছে, কিন্তু কংগ্রেস তাঁকে বাংলার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে এই বিষয়ে অধীর রঞ্জন চৌধুরীর কোনও অনুশোচনা নেই, বরং তিনি খারাপ বোধ করছেন যে তাঁকে সঠিকভাবে বলা হয়নি। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরেই অধীর রঞ্জন চৌধুরী তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলেন। তবে তাঁর পদত্যাগ গৃহীত হয়েছে কি না তা তাঁকে জানানো হয়নি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রাহুল গান্ধী এত সদয় কেন?
লোকসভা নির্বাচনের সময়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় INDIA ব্লকের বৈঠকে বলেছিলেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত করা উচিত। পরে, তিনি নিজেকে কংগ্রেস থেকে দূরে রাখতে শুরু করেন, এবং রাহুল গান্ধীর ন্যায় যাত্রা পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছনোর ঠিক একদিন আগে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে টিএমসি কারও সঙ্গে কোনও নির্বাচনী জোটে যাবে না, একা লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তারপরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি খুবই নরম ছিল কংগ্রেস। রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ কাউকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু বলতে শোনা যায়নি। বরং অনেকবার বলা হয়েছিল যে টিএমসি-র সঙ্গে আলোচনা করছে কংগ্রেস এবং আলোচনা থেকে একটি সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসবে, কিন্তু শেষ অবধি কোনও কিছুই হয়নি।
লোকসভা নির্বাচনের ফল আসার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন যে যদি ইন্ডিয়া ব্লকের সরকার গঠিত হয় তবে টিএমসি বাইরে থেকে সমর্থন করবে। যদিও পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার করে বলেন যে তিনিও জোটে রয়েছেন। এখন সরকার গঠিত হয়নি, তবে বিরোধী দল অবশ্যই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। খোদ সংসদ অধিবেশনেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কংগ্রেসের দাবি, সবচেয়ে প্রবীণ সাংসদ কে সুরেশকে প্রোটেম স্পিকার করা হয়নি। এর প্রতিবাদে কংগ্রেস কে সুরেশকে ইন্ডিয়া ব্লক থেকে স্পিকার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং টিএমসি সমর্থন পত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন। টিএমসি অভিযোগ করেছে যে প্রার্থী ঘোষণা করার আগে তাদের সঙ্গে পরামর্শও করা হয়নি। রাহুল গান্ধী পুরো বিষয়টি জানতে পেরে নিজেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসন্তোষ দূর করার দায়িত্ব নেন। সঙ্গে সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেন রাহুল গান্ধী। দুই নেতা প্রায় আধঘণ্টা কথা বলেন- আর তারপরেই রাজি হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনও পর্যন্ত লোকসভায় বিরোধীদের একই সুরে দেখা গিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদদেরও আলাদা আচরণ করতে দেখা যায়নি। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধীর প্রতি তৃণমূল সাংসদদের শ্রদ্ধার কোনও অভাব নেই। রাহুল গান্ধীকে আমাদের নেতা বলে সম্বোধন করেছেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র।
কিন্তু সম্প্রতি এটাও দেখা গিয়েছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীতি আয়োগের বৈঠকে গিয়েছিলেন। তিনি হেমন্ত সোরেনকেও সঙ্গে নিয়ে যান। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীদের পাশাপাশি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনও নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে যোগ দিলেও মাঝপথে বেরিয়ে আসেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক এনডিএ নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আসলে বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলেছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা পরিকল্পনা করেছিলেন সেটাই তিনি করেছেন। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান থেকে মনে হচ্ছে তিনি নীতি আয়োগের বৈঠকে গিয়েছিলেন কংগ্রেসকে পাঠ শেখানোর উদ্দেশ্যেই এবং মনে হচ্ছে রাহুল গান্ধীও বুঝতে পেরেছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন। কেন্দ্রে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যাবে না যতক্ষণ না অধীর রঞ্জন চৌধুরী পথের কাঁটা হয়ে থাকবেন এবং এই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছাকাছি আনতে অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।